বেপরোয়া বাইকের দাপটে নাজেহাল রাতের কলকাতা
2015.10.29
পার্ক সার্কাসের কড়েয়া আবাসনের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা দীপক সেনগুপ্ত। পার্ক সার্কাস জায়গাটা এমনই, আগে রাত দেড়টা দুটোর সময়ও নির্ভয়ে হাঁটা যেত রাস্তায়। ইদানীং কয়েক বছর আর সেই ঝুঁকি নেন না দীপকবাবু। কারণ, ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর ছুঁলেই তাঁদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তার মোড়ে জমায়েত হয় তরুণদের। প্রত্যেকেরই দামি মোটরবাইক, কিন্তু প্রায় কারও মাথায় হেলমেট থাকে না। তার পর বিকট শব্দে বাইক হাঁকিয়ে তারা ছুটে চলে শহরের রাজপথে, নতুন সব উড়ালপুলে। তাদের হাবভাবই বলে দেয়, কাউকে তোয়াক্কা করে না তারা। পুলিশকে নয়, কোনও প্রবীণ নাগরিককে তো নয়ই।
এই বাইকবাজরাই কলকাতা পুলিশের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে।
পুলিশের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘রোজ রাতেই এগারোটা থেকে তিনটে অবধি দৌরাত্ম্য চলছে। এদের পছন্দের রাস্তা হল রেড রোড, খিদিরপুর, জওহরলাল নেহরু রোড, সৈয়দ আমির আলি এভিনিউ, ভিআইপি রোড, ইস্টার্ন বাইপাস আর অতি অবশ্যই কলকাতায় তৈরি হওয়া সব নতুন ফ্লাইওভার। এজেসি বোস রোড ফ্লাইওভার, বাগুইআটি ফ্লাইওভার, দ্বিতীয় হুগলি সেতু এবং এই পুজোর মুখে খুলে দেওয়া পরমা ফ্লাইওভার— এই উড়ালপুলগুলোও এখন বাইকবাহিনীর পছন্দের রাস্তা।’
‘এর পর যখন পরমা ফ্লাইওভারটি র্যাম্পের মাধ্যমে এজেসি বোস রোড ফ্লাইওভারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে, তখন বাইপাসের পরমা আইল্যান্ড থেকে হাওড়ার নবান্ন অবধি দীর্ঘ পথ যে এই বাইকবাজদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে, কোনও সন্দেহ নেই।’ বললেন সঞ্জীববাবু। তাঁর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে বেশি দূরে তাকানোর প্রয়োজন নেই। যে দিন পরমা ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হল, সে দিনই সেই উড়ালপুলে বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় দুই আরোহীর।
বাইকের তাণ্ডবে যে শুধু পথচারীরাই বিপর্যস্ত, তা নয়। বেপরোয়া দৌড়ে মারা যাচ্ছে বাইক আরোহীরাও। কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গেল, এ বছর কলকাতার রাস্তায় বিপজ্জনক ভাবে বাইক চালিয়ে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১২০ জনেরও বেশি। গত এক মাসেই মৃত্যু হয়েছে পনেরো জন বাইকবাজের। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাইক ধাক্কা মারছে উড়ালপুলের দেওয়ালে। গতিবেগ এতই বেশি থাকছে যে বাঁচার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবানরা হাসপাতালে পৌঁছোচ্ছে। ঠিক কত দুর্ঘটনা ঘটেছে গত এক বছরে, তার পুরো হিসেব দেওয়া সম্ভব নয় বলেই মত কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে কর্মরত অফিসারদের।
ছবিটা অবশ্য গোটা ভারতেই দুশ্চিন্তাজনক। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, গোটা বছরে ভারতে পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে মোট ৭৫,০০০ তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। সংখ্যাটি দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মোট সংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ। এটি কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রকের ট্রান্সপোর্স রিসার্চ উইং-এর দেওয়া পরিসংখ্যান। একই সঙ্গে জানা গিয়েছে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত তরুণদের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন মারা যান বাইক দুর্ঘটনায়।
কলকাতায় বেপরোয়া বাইক চালাচ্ছে কারা? পুলিশসূত্রের বক্তব্য, অধিকাংশেরই বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। বেশির ভাগেরই বা়ড়ি খিদিরপুর-মোমিনপুর, অথবা পার্ক সার্কাস-বেকবাগান অঞ্চলে, অথবা তপসিয়া-ট্যাংরা এলাকায়। অনেকেই এখনও স্কুলছাত্র, কেউ কলেজছাত্র, এবং অনেকে মাঝপথেই লেখাপড়া ছেড়ে কাজ ধরেছে।
এই বাইকবাজদের প্রত্যেকেই যে সম্পন্ন পরিবারের, তা কিন্তু নয়। অনেকের পরিবারেই এখনও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বড়লোক বন্ধুর বাইকে গরিব তরুণ সওয়ার, এমন ঘটনাও আখছার ঘটছে। এবং, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছেলের বেপরোয়া কার্যকলাপ বিষয়ে মা-বাবা সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকেন। গোপনে তৈরি হয়েছে বাইক দৌড়ের ক্লাব। মোটা টাকা বাজি রেখেও দৌড় হচ্ছে।
এই বাইকবাহিনীর তাণ্ডব সামলাতে পুলিশ নাজেহাল। কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বললেন, ‘মোটর বাইকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রশ্নই নেই। কিন্তু কী ভাবে এই প্রবণতা ঠেকানো যায়, আমরা ভাবছি।’ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সার্জেন্ট বললেন, ‘রাতে রাস্তা ফাঁকা থাকায় যে গতিতে বাইকগুলি আসে, তাতে সেই বাইক থামানো সম্ভব নয়। জোর করে থামাতে গেলেই বরং দুর্ঘটনা ঘটবে। কাজেই, আমরা দেখেও ধরতে পারি না।’ পুলিশকর্মীদের নিরাপত্তার প্রশ্নও আছে। গত এক বছরেই অন্তত দুটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বেপরোয়া বাইকবাজকে থামাতে গিয়ে সেই বাইকের ধাক্কায় গুরুতর জখম হয়েছেন কর্মরত পুলিশকর্মী।
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অ্যাডিশনাল ডিসিপি (ট্রাফিক) শিবানি তিওয়ারি জানিয়েছেন, বাগুইআটি ফ্লাইওভারে বাইক রেসিং থামানোর জন্য নিয়মিত পুলিশ পেট্রলের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু, তাতে কতখানি কাজ হবে, সন্দিহান কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দীপক আইচ। তিনি বললেন, ‘শহরের সব বড় রাস্তা বা ফ্লাইওভারে নিয়মিত টহলদারি করতে যত কর্মী এবং যত গাড়ি বা বাইক প্রয়োজন, তা কলকাতা পুলিশের নেই। কাজেই, পুলিশের সঙ্গে বাইকবাজদের লুকোচুরি খেলা চলবেই।’
তা হলে কি এই মারাত্মক খেলা থামানোর কোনও উপায় নেই? মানতে নারাজ কলকাতা পুলিশের কর্তারা। পুলিশের ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে, শহরে দুর্গাপূজা চলাকালীন ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে। প্রায় ৫০০ মোটরবাইক আটক করা হয়েছে। তবে, পুলিশকর্তারাই বলছেন, শহরে যত বেপরোয়া বাইকবাজ আছে, আটকের সংখ্যা তার বড় জোর দুই শতাংশ। তবে, অভিযান চলবে বলেই জানা গিয়েছে।
অন্য দিকে, দুর্ঘটনা ঘটলেও তাতে যাতে প্রাণহানির আশঙ্কা কমে, সেই ব্যবস্থা করারও চেষ্টা চলছে। উড়ালপুলগুলিতে গার্ডরেল ও শক অ্যাবজর্ভার লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছে। অন্ধকারেও চোখে পড়ে, এমন পথবিভাজিকা তৈরি করার পরিকল্পনাও আছে।
তবে, উদ্দাম বাইকদৌড় এখনই থামবে, কলকাতাবাসীরা ততখানি আশাবাদী নন।