পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা, আগামী সপ্তাহে অভিযান
2019.02.22
ঢাকা
চকবাজার ট্র্যাজেডির মতো অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানার বা গুদামের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত দাহ্য ২৯টি রাসায়নিকও চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নেতৃত্বে আগামী সপ্তাহ থেকেই এ অভিযান শুরু হবে বলে শুক্রবার বেনারকে জানিয়েছেন ডিএসসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা চকবাজারসহ পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় সকল রাসায়নিক গুদাম মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী সপ্তাহে অভিযান শুরু করব।”
পুরোনো ঢাকায় ঠিক কতটি রাসায়নিক কারখানা বা গুদাম আছে তার সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি মোস্তাফিজুর রহমান। তবে বলেন, “এ সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। এসব রাসায়নিক গুদাম অধিকাংশ অবৈধভাবে করা হয়েছে।”
শুক্রবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুত সম্ভব রাসায়নিকের গুদাম সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেও শুরু করেছেন।”
এদিকে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বেনারকে বলেন, তাঁর বিভাগ ২৯টি অত্যন্ত দাহ্য রাসায়নিকের তালিকা করেছে, যা পুরোনো ঢাকার মতো আবাসিক এলাকায় সংরক্ষণ করা উচিত নয়।
বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে একটি চারতলা ভবনসহ আরও কয়েকটি ভবন জুড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৬৭ জন। ওসব ভবনে থাকা রাসায়নিক আর প্লাস্টিক-পারফিউমের গুদাম আগুনকে ভয়াবহ মাত্রা দেয়।
নজরদারির অভাব ছিল
শুক্রবার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে অগ্নিদগ্ধদের দেখে ফেরার পথে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডের পর নজরদারির অভাব ছিল।
“নিমতলির ঘটনার পর কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ক্লোজ মনিটরিংয়ের অভাব ছিল। তাই আবার এখানে গোডাউন করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। সরকারের কোনো গাফিলতি আছে কি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন তাঁরা সবকিছুই খতিয়ে দেখবেন।
কতটা ঝুঁকিতে পুরান ঢাকা
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আদি ঢাকাবাসী ফোরামের সদস্যসচিব জাভেদ জাহান বেনারকে বলেন, “পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ঝুঁকির ভেতর আছেন। আর সে জন্য দায়ী দাহ্য পদার্থের কারখানা।”
“নিমতলিতে দুর্ঘটনার পর আমরা দাবি জানিয়েছিলাম কোনোভাবেই রাসায়নিকের গুদাম আবাসিক এলাকায় থাকতে পারবে না। কিন্তু কারখানাগুলো সরেনি। মানুষ বাস করছে মৃত্যুর সঙ্গে,” বলেন তিনি।
সরেজমিনে ঘুরে পুরান ঢাকার নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এমন বেশ কিছু শিল্পের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে রাবার, প্লাস্টিক ও জুতা তৈরির কারখানা, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিকের গ্রানুয়েলস, গুটি, রং, ভাঙারি, ইমিটেশনের গয়না, লেদ মেশিন, তারকাঁটা, নকল শ্যাম্পু, পারফিউম বানানোর কারখানাও।
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিসের অন্যতম পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি মুখোমুখি হন সাংবাদিকদের।
“এখানে ভবনগুলোর মধ্যে সুগন্ধির ক্যান ছাড়াও লাইটার রিফিল করার ক্যান ছিল। এগুলো অবশ্যই কেমিক্যাল,” বলেন জুলফিকার রহমান।
দুর্ঘটনাস্থলে কমপক্ষে ১১টি রাসায়নিকের সন্ধান পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা।
সুপারিশ মানা হয়নি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি তদন্ত কমিটি ১৭ দফা সুপারিশ রেখেছিল। এর মধ্যে আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক ও বিস্ফোরক মজুত ও বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা এবং জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ থাকলেও তা মানা হয়নি। মানা হয়নি আদালতের আদেশও।
২০১০ সালের ১০ জুন ছয়টি বেসরকারি সংগঠন ও একজন ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
সরকার নয় বছরেও প্রতিবেদন জমা দেয়নি, রুলের জবাব দেয়নি। হাইকোর্টও নতুন করে আর আদেশ জারি করেনি।
নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার একটা উদ্যোগ ছিল। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদন পেতে আট বছর লেগেছে। প্রকল্পটির পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি। জুলাই মাসে অধিগ্রহণ শুরুর একটা পরিকল্পনা আছে।
শনাক্ত হয়নি ২১ লাশ
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে নিহত ২১ জনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি এখনও। অগ্নিকাণ্ডে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থাকা দালানকোঠায় ফেরেননি কেউ।
বৃহস্পতিবার মৃতদেহগুলো হস্তান্তর শুরুর পরে শুক্রবার পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ৪৬টি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে। শুক্রবার সকালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি মর্গের পাশে বুথ স্থাপন করে মৃতদেহ শনাক্ত করতে স্বজনদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
শনিবারও এই কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট। তবে কবে নাগাদ মৃতদেহ বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
“সিআইডির ডিএনএ ল্যাবটি অত্যাধুনিক। নিয়মিত এখানে শনাক্তকরণের কাজ হয়ে থাকে। তবে মৃতদেহগুলো এত বেশি পুড়ে গেছে, এগুলো শনাক্ত করা রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং,” বেনারকে বলেন নুসরাত ইয়াসমিন।
মৃতদেহগুলোর হাড় ও দাঁতের নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। স্বজনদের রক্ত ও মুখের ভেতরের কোষ সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মৃতদেহগুলো হস্তান্তর হয়ে যাওয়ায় কাল মর্গের সামনে তেমন ভিড় ছিল না। ছিল স্বজনকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষারত মানুষেরা। এই তালিকাতেই ছিল পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু সানিন। মামা মো ইস্রাফিলের কোলে চড়ে সে এসেছিল ডিএনএ নমুনা দিতে। ইস্রাফিল বলছিলেন, সানিন এখনো বুঝে উঠতে পারছে না মা কোথায়।
“আমার বোন বিবি হালিমা বেগম শিলা সানিন আর ওর পাঁচ মাস বয়সী ছোট বোনকে খালাদের কাছে রেখে ওষুধ কিনতে গিয়েছিল চুড়িহাট্টায়। আর ফেরেনি,” ইস্রাফিল বেনারকে বলেন।