কঙ্গোয় দুর্ঘটনা: বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নারী পুলিশ কর্মকর্তা নিহত
2019.05.06
ঢাকা

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক রৌশন আরা বেগম, যিনি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী হিসেবে এই পদে আসীন ছিলেন।
আফ্রিকার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর রাজধানী কিনশাশার একটি মহাসড়কে স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টরের দায়িত্বে থাকা রৌশন জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ ফ্রন্ট পুলিশ ইউনিটের মেডাল প্যারেডে যোগ দিতে শনিবারেই ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে পৌঁছান।
রৌশন আরার (৫৭) মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। তাঁরা মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কর্মকর্তা ও সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এর মধ্যে ১২ হাজার নারী যা মোট সংখ্যার ছয় ভাগের কিছু বেশি।
আর রৌশন আরা আটজনের মধ্যে একমাত্র অতিরিক্ত নারী পুলিশ মহাপরিদর্শক। তিনি ২০১৮ সালে ৬ নভেম্বর অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “রৌশন আরা ছিলেন বাংলাদেশের নারীদের জন্য একজন দৃষ্টান্ত। তিনি প্রমাণ করেছেন, নারীরাও পুলিশের উচ্চপদে আসীন হয়ে নিষ্ঠা ও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে।”
তিনি বলেন, “তাঁকে দেখে অন্য নারীরা পেশা হিসাবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী হতো। রৌশন আরার অকাল মৃত্যু আমাদের দেশের জন্য একটি বড় ক্ষতি।”
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, রৌশন আরা বেগম জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ ফ্রন্ট পুলিশ ইউনিটের মেডেল প্যারেডে যোগ দিতে শনিবার কঙ্গো যান। রোববার রাতে প্রধান অতিথি হিসাবে এক নৈশভোজে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন তিনি।
কিনসাসার একটি মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ হারানো একটি লরি তাঁকে বহনকারী গাড়িকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান রৌশন আরা। ধাক্কায় গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়।
আহত হন তাঁর সহযাত্রী মিশন কমান্ডার পুলিশ সুপার ফারজানা ইসলাম এবং গাড়ির চালক। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ মঙ্গলবার তাঁর দেশে ফেরার কথা ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “রৌশন আরার লাশ কবে দেশে আসবে সে ব্যাপারে এখনো কিছু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “জাতিসংঘ অফিসের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। যত দ্রুত সম্ভব তাঁর লাশ দেশে ফেরত আনা হবে।”
সোহেল রানা বলেন, “রৌশন আরা ছিলেন, অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, যোগ্য ও কর্মঠ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি নিঃসন্দেহে অন্যান্য নারীদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি।”
তিনি বলেন, “রৌশন আরার স্বামী এবং একমাত্র মেয়ে বর্তমানে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। তাঁরা দেশে ফিরে আসছেন।”
কিনসাসা মিশনের এক সদস্য জানান, ইউনিট কমান্ডার ফারজানার গাড়িতে চড়ে সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে যান রৌশন আরা।
কঙ্গোর বিভিন্ন স্থান ঘুরে সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মিশনে ফিরছিলেন। পথেই তিনি দুর্ঘটনায় পড়েন।
রৌশন আরাই বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম নারী কর্মকর্তা যিনি পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার ছিলেন। একই সাথে অতিরিক্ত আইজিপির পদে বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী কর্মকর্তা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স করে ১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন রৌশন আরা।
কর্মজীবনে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ঢাকায় বিশেষ পুলিশ সুপার, খুলনার মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত কমিশনারের দায়িত্বে পালন করেন।
এ ছাড়া ঢাকায় ডিটিএস, সিআইডি’র কমান্ড্যান্ট, সিআইডির স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ও ফরেনসিক বিভাগের ডিআইজি হিসেবে করেন।
তিনি সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কসোভোয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ক্রাইম অ্যানালাইসিস অফিসার, সুদানে আনমিস-আনপোল শান্তিরক্ষা মিশনের চিফ অব স্টাফ হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
দায়িত্ব পালনে কৃতিত্বের জন্য রৌশন আরা দুই বার আইজিপি ব্যাজ পান এবং বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুলিশ পদক পিপিএম অর্জন করেন।
দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ পাওয়া রৌশন আরা বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি ছিলেন।
এছাড়া তিনি ছিলেন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের বাংলাদেশ পুলিশের ফোকাল পয়েন্ট এবং নেটওয়ার্কের কার্যকরী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব।
১৯৯৮ সালে মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার থাকার সময় ‘অনন্যা শীর্ষ দশ-১৯৯৮’ পুরস্কার এবং ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০১২ লাভ করেন রৌশন আরা।