রাজীবের পরিবারকে কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ
2018.05.08
ঢাকা
বাসের চাপায় নিহত রাজীব হোসেনের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ—বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন কর্তৃপক্ষকে পঞ্চাশ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধের জন্য এক মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের দ্বৈত বেঞ্চ এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। গত ৩ এপ্রিল কারওয়ানবাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাসের প্রতিযোগিতায় পড়ে প্রথমে হাত ও পরে প্রাণ হারান কলেজছাত্র রাজীব হোসেন। বাবা মা হারা সংগ্রামী এই তরুণের করুণ পরিণতি পুরো দেশের মানুষকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল একই বেঞ্চ কেন রাজীব হোসেনকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, বাস (স্বজন) পরিবহনের মালিকসহ আটজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। বিষয়টি কোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাজীবের অভিভাবক জাহানারা খাতুন বলেন, আদালত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রায় দিয়েছেন। এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ।
“রাজীবের পরও কতজন আহত হলো, মারা গেল। আশা করি আদালত সবার জন্যই ব্যবস্থা নেবেন," জাহানারা খাতুন বেনারনিউজকে বলেন।
রাজীবের সপ্তম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুটি ভাই আছে। রাজীব টিউশনি করে ও কম্পিউটার কম্পোজ ও গ্রাফিক্স এর কাজ করে তার দু ভাই মেহেদি হাসান ও আবদুল্লাহর খরচ চালাতেন।
আদালতে রাজীব হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন রুহুল কুদ্দুস কাজল। আদেশের পর তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ক্ষতিপূরণের অর্ধেক দেওয়ার জন্য একমাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
“এ জন্য মতিঝিলে সোনালি ব্যাংকের প্রধান শাখায় যৌথ নামে অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,” রুহুল কুদ্দুস বলেন।
বিআরটিসির পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার মুনিরুজ্জামান। আদালতের আদেশের পর মুনীরুজ্জামান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
“বিআরটিসির বাসটি দ্রুতগতিতে চলছিল না। দোষ ছিল স্বজন পরিবহনের বাসের। সে ক্ষেত্রে আদেশ পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি,” ব্যারিস্টার মুনিরুজ্জামান বলেন।
ভুক্তভোগীদের ভাবনা
রাজীব হোসেন আহত হওয়ার দুদিনের মাথায় বিকাশ পরিবহনের দুটো বাসের রেষারেষিতে পড়েন আয়েশা খাতুন। ৫ এপ্রিল ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনি লালবাগ থেকে ধানমন্ডিতে যাচ্ছিলেন রিকশায় করে।
বিকাশ পরিবহনের দুটি বাসের মাঝখানে পড়ে যান আয়েশা। বাসটি টেনে হিঁচড়ে তাঁকে অনেক দূর নিয়ে যায়। আয়েশা এখন পঙ্গু। কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেছে তাঁর।
আয়েশার স্বামী তানজির আহমেদ গতকাল আদালত যে আদেশ দিয়েছেন তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে তাঁর শঙ্কা অভিযুক্ত গাড়ি চালকদের বিচার হবে কি না তা নিয়ে।
“ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা গেলে অন্তত মালিকপক্ষ গাড়িচালকদের প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু শুধু ক্ষতিপূরণই কি যথেষ্ট? গাড়িচালকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার। কারণ অর্থমূল্যে এই ক্ষতি পরিশোধযোগ্য নয়,” তানজির আহমেদ বেনারকে বলেন।
আয়েশা আহত হওয়ার পর আদালত সরকারকে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়, পাশাপাশি বিকাশ পরিবহনকে চিকিৎসার খরচ ও প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। বিকাশ পরিবহন আয়েশার পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। অভিযুক্ত দুই বাস চালক ১২ দিন পর জামিনে বেরিয়ে এসেছেন বলে নিশ্চিত করেছে নিউমার্কেট থানা-পুলিশ।
আয়েশার ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আদালতের আদেশ দেওয়ার জন্য আজ বুধবার দিন ধার্য করা আছে।
সবার জন্য প্রযোজ্য হোক
রাজীব হোসেনের পর কমপক্ষে আরও পাঁচটি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলো সোচ্চার ছিল। সংগঠনগুলো বলছে, সবার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রযোজ্য হওয়া দরকার।
গত ৩ মে দেশের শীর্ষ বাংলা দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “উচ্চ আদালত যখন অসাধারণ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তখন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এমন একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার যাতে ভুক্তভোগীরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিয়মিত প্রতিকার পান।”
তিনি আরও বলেন, “এ–সংক্রান্ত আইনের সংশোধনের বিষয়টি সাত বছর ধরে ঝুলে আছে। ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড, জবাবদিহি, সুরক্ষার বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন।”
সারা হোসেন ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আইনি সহযোগিতা দেন। ওই মামলায় আদালত আসামিপক্ষকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
পুরো পরিস্থিতি নিয়ে ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের পরিবহন বিশেষজ্ঞ মারুফ রহমান কথা বলছিলেন বেনারনিউজের সঙ্গে।
“এখন ভাবতে হবে পরিবহন মালিকপক্ষ ও সরকার কি শুধু ক্ষতিপূরণই দিতে থাকবে, নাকি পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করবে?” মারুফ রহমান বলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম আর বিশ্বে ১৩তম।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয় বছরে ২১ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সরকার অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই তথ্য মানতে রাজি হয়নি।
একই বছর যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে নিহতের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৮ হাজার। সরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৭৬। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাণহানির সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তাগিদ দিয়েছে।