সাহায্য নিতে গিয়ে অন্তত ১০ নারীর মৃত্যু, আহত অর্ধশতাধিক
2018.05.14
ঢাকা

আপডেট: ১৫ মে, ইস্টার্ন টাইম সকাল ৯:৩০
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নে বিনা মূল্যের ইফতার (শুকনো খাবার) ও জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা গেছেন অন্তত ১০ নারী। আহত হয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক।
শিল্পপতি ও কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির মালিক মোহম্মদ শাহাজাহান তাঁর পশ্চিম গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামের বাড়িতে সোমবার সকালে এই সাহায্য বিতরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।
মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে উল্লেখ করে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ঘটনাস্থলেই নয় নারীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরও একজন। সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা) নয়জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। সাতকানিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বেনারকে জানান, ঘটনাস্থলে নিহতদের তিনজন সাতকানিয়া, তিনজন লোহাগাড়া, দুজন দোহাজারী এবং একজন বান্দরবান থেকে এসেছিলেন।
হাসপাতালে যিনি মারা গেছেন, তাঁর ঠিকানা-পরিচয় পায়নি প্রশাসন।
নলুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান তছলিমা আবছার বেনারকে জানান, বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও সাহায্যপ্রার্থীরা এসেছেন। আহতরা সবাই দূর-দূরান্তের, কেউই তাঁর ইউনিয়নের নন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) এ কে এম এমরান ভূঁইয়াও সাংবাদিকদের বলেন, “কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার মানুষ ওই বাড়িতে ভিড় করেছিলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও সেখানে বান্দরবান-কক্সবাজার জেলা থেকে লোকজন এসেছিল।”
প্রাথমিক দায় অব্যবস্থাপনার
প্রশাসনের অভিমত, নিহতদের মৃত্যুর কারণ ‘হিট স্ট্রোক’। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) নুরে আলম মিনা সাংবাদিকদের বলেন, “তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক এবং শ্বাসকষ্টে এদের মৃত্যু হয়েছে।”
তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে একাধিক গণমাধ্যম দাবি করেছে, তাঁরা পদদলিত হয়ে মারা গেছেন। ঘটনাস্থলে থাকা তছলিমা এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “লাশগুলো ক্ষতবিক্ষত মনে হচ্ছে না। যে কারণে তাঁদের মৃত্যুর কারণ ‘হিট স্ট্রোক’ বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
“হাজার হাজার সাহায্যপ্রার্থী রবিবার রাত থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। প্রচণ্ড ভিড়ের চাপের মধ্যে তাঁদের অনেকে অভুক্ত ও পিপাসার্ত ছিলেন,” যোগ করেন এই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
কেএসআরএম (কবির স্টিল রি-রোলিং মিল) লিমিটেডের মালিক শাহজাহান প্রতি বছর এভাবে সাহায্য সামগ্রী বিতরণ করেন জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, “এবার ব্যাপক প্রচারণা করা হয়েছিল, সে অনুযায়ী আয়োজনও ছিল; শুধু ব্যবস্থাপনা ঠিক ছিল না।”
ঘটনাস্থল থেকে ফিরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইলিয়াস হোসেনও বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি অব্যবস্থাপনার জন্যই এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।”
কেএসআরএম’র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) রফিকুল হক এবারের আয়োজন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, “নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
“সেখানে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াও পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল,” দাবি করেন তিনি।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৫ সালের ৭ অক্টোবর একই কারণে পদদলিত হয়ে আট জন নিহত হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর সাহায্য বিতরণ বন্ধ ছিল।
প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠিত
ইউএনও মোবারক বেনারকে জানান, ডিসির নির্দেশে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাসহুদুল কবিরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে পুলিশ বিভাগ এবং সিভিল সার্জন অফিসের প্রতিনিধিও রয়েছেন।
“এই কমিটি সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। তাঁরা এ ঘটনায় কেউকে দোষী সাব্যস্ত করলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” সাংবাদিকদের বলেন ডিসি ইলিয়াস।
ইউপি চেয়ারম্যান তছলিমা জানান, বর্তমানে সাতকানিয়ার ইউএনও এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ঘটনাস্থলে আছেন। লাশগুলোর পরিচয় উদ্ধার করে হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিন বছরে নিহত কমপক্ষে ৪৮
বাংলাদেশে ধনীদের আমন্ত্রণে সাড়া দিতে গিয়ে গত তিন বছরে কমপক্ষে ৪৮ জন দরিদ্র মানুষ মারা গেছেন।
এই চট্টগ্রামেই গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে ‘মেজবান’ খেতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ১০ জন প্রাণ হারান।
এর আগে ২০১৫ সালে জুলাইয়ে ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ২৭ জন নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে এখনো দেশের মোট জনসংখ্যার ২২-২৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। যে কারণে তাঁরা যখন কোনো সাহায্য বিতরণের ঘোষণা শোনেন, স্বভাবতই আগ্রহী হয়ে ওঠেন।”
“এ ক্ষেত্রে দাতাদের মনোভাব বদলাতে হবে। ঢাকঢোল পিটিয়ে সাহায্য প্রদানের সংস্কৃতি ধর্মও সমর্থন করে না। ‘ইসলাম পরিপন্থী’ এই কর্মকাণ্ড ঠেকাতে সরকার মসজিদের ইমামদের সাহায্য নিতে পারেন,” যোগ করেন দেশের সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “এ জাতীয় ঘটনা দেশে বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যের চরম প্রকাশ। দান-সদকার নামে এভাবে মানুষ খুনের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।”
“কিছু মানুষ অন্যায়ভাবে আয় করা টাকা ছিটিয়ে ‘সোস্যাল প্রেস্টিজ’ বাড়াতে চায়। এর সাথে ধর্মের আদৌ কোনো সংশ্লেষ নেই,” দাবি করে তিনি আরো বলেন, “ধর্মের নামে এই অনাচার আর বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না।”
বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক এই সভাপতির অভিমত, “ব্যক্তিগত সাহায্যদানের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। কারণ পদদলিত হয়ে এত মানুষের মৃত্যু দেশের বহু সাফল্য ম্লান করে দিচ্ছে।”