নারায়ণগঞ্জে বিস্ফোরণ: গ্যাসের পাইপলাইনের ওপর মসজিদ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.09.08
ঢাকা
200908_Narayangj_Explosion-1000.JPG ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনদের আহাজারি। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা এলাকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটা মসজিদের সিঁড়ির নিচে গ্যাসের পাইপ লাইনের সন্ধান পেয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সেখানে গ্যাসের লাইনের ওপর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

ওই অগ্নিকাণ্ডে মঙ্গলবার রাতে মো. হান্নান (৫০) নামে আরেকজন প্রাণ হারিয়েছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম।

তিনি বলেন, হান্নানসহ এই ঘটনায় ২৮ জনের প্রাণহানি ঘটল। ঢাকা মেডিকেল চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও আটজন। তাঁদের অবস্থাও সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

কী ঘটেছিল?

নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে কর্মরত মো. নুরুদ্দিনের দুই কলেজ পড়ুয়া ছেলে বিস্ফোরণে মারা গেছেন। বড়ো ছেলে সাব্বির (২১) স্নাতক শ্রেণিতে, মেজো ছেলে জুবায়ের (১৮) উচ্চমাধ্যমিক এবং ছোট ছেলে মো. ইয়াসিন (৯) মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে।

অন্যান্য দিনের মতো শুক্রবার রাতে তিন ভাই একসাথে এশার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যায়।

নুরুদ্দিন বেনারকে বলেন, “যখন মসজিদে ফরজ নামাজ শুরু হয় তখন বিদ্যুৎ ছিল না। আমার ছোট ছেলে ফরজ নামাজ আদায় করে বাসায় চলে আসে। কিন্তু বড় ও মেজ ছেলে নফল ও অন্যান্য নামাজ আদায়ের জন্য থেকে যায়।”

“ফরজ নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বিদ্যুৎ চলে আসে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে, আগুন জ্বলে ওঠে,” বলেন নুরুদ্দিন।

পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা সাব্বির ও জুবায়েরকে উদ্ধার করে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর আমার দুই ছেলেই মারা যায়।”

“ছোট ছেলে মসজিদ থেকে বের না হয়ে আসলে সেও হয়তো বাঁচত না,” বলেন নুরুদ্দিন।

তিনি বলেন, তাঁর ছেলেরা নিয়মিত ওই মসজিদে নামাজ আদায় করত। ওই মসজিদে প্রায়ই গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেত। মসজিদ কমিটির লোকেরা তিতাসের লোকদের সাথে কথা বলেছিল। কিন্তু তারা জানায়, গ্যাসের ছিদ্র মেরামত করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। সেকারণে এই ছিদ্র মেরামত হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

জেলা প্রশাসনের গঠন করা পাঁচ সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে তিতাস গ্যাসের কমিটির প্রধান করা হয়েছে তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল ওয়াহাবকে। কমিটি মসজিদের নীচ দিয়ে চলে যাওয়া পাইপলাইনে কোনো ছিদ্র থেকে গ্যাস বেরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে কি না তা তদন্ত করে দেখবে।

তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে সোমবার থেকে মসজিদের চারপাশে খনন কাজ শুরু করেছে তিতাস গ্যাসের তদন্ত কমিটি।

মঙ্গলবার বিকালে দ্বিতীয় দিনের খননের পর সিঁড়ির নীচে পাইপলাইনের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিতাসের নারায়ণগঞ্জের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মফিজুল ইসলাম।

তবে তিনি বলতে পারেননি ওই পাইপলাইনে কোনো ছিদ্র ছিল কি না।

কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী

রোববার সংসদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সারা বাংলাদেশেই মসজিদগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে ইচ্ছেমতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা লাগানো হচ্ছে।

“যেখানে সেখানে একটা মসজিদ গড়ে তুলছেন। সে জায়গাটা আদৌ একটা স্থাপনা করবার মতো কিনা, বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়া বা সেভাবে নকশাগুলো করা হয়েছে কিনা- সে বিষয়গুলো কিন্তু দেখা একান্ত প্রয়োজন। নইলে নারায়ণগঞ্জের মতো এ ধরনের দুর্ঘটনা যে কোনো সময় ঘটতে পারে,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিদ্যুত ও গ্যাস কর্তৃপক্ষকে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পেছনের কারণগুলো শনাক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ফতুল্লার অধিবাসী আব্দুল গফুর জানান, ২০০০ সালের দিকে ‘বাইতুস সালাত জামে মসজিদ’ নামের’ ওই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তবে মসজিদ নির্মাণের সময় অনুমতি নেয়া হয়েছিল ছিল কি না সেব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি তিনি।

গফুর বলেন, মাঝে মধ্যেই মসজিদের মধ্যে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেত। এবং বিষয়টি নিয়ে তিতাস গ্যাস অফিসে জানানো হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।

‘মসজিদ নির্মাণে অনুমতি প্রয়োজন’

দেশের যে কোনো স্থানে পাকা বাড়ি বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের প্রধান নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, নিয়মটি “মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।”

তবে “মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে কেউ কোনো অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না,” মন্তব্য করে অধ্যাপক নজরুল বলেন, “সেকারণে, রাস্তার মাঝখানে, নদী ও জলাশয়ের মধ্যে, খাস জমির ওপর রেললাইনের পাশে অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বিষয়টি ধর্মীয় বিধায় কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। আর এই সুযোগে স্বার্থান্বেষী মহল সরকারি জমি, স্থাপনা দখলের জন্য রাতারাতি মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করে থাকে।”

“নারায়ণগঞ্জে দেখা গেলো গ্যাসের লাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আর এর ফল হলো ২৭ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারালো,” যোগ করেন অধ্যাপক নজরুল।

অনুমোদন ছাড়া মসজিদ নির্মাণ বিষয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “এর আগে কেউই এবিষয়ে কথা বলেননি বা বলার চেষ্টা করেননি।”

“প্রথমবারের মতো মসজিদ নির্মাণের অনুমতি নিয়ে কথা হচ্ছে। এটি একটি ভালো দিক। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে যাঁরা মসজিদ নির্মাণ করবেন তাঁরা মুসল্লিদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে নির্মাণ করবেন,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।