নেপাল দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট আবিদের শোকে স্ত্রী আফসানারও মৃত্যু
2018.03.23
ঢাকা

বেশি শোকে পাথর হয়ে গেছে ছেলেটি, কথাই বলছে না—সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া তামজিদ বিন সুলতান মাহীর কথা বলছিলেন তার চাচী মৌসুমী মাহমুদ তান্নি।
কেবল মাহী নয়, ওই পরিবার ও আত্মীয়–স্বজন—সবার একই অবস্থা। ১৬ বছরের ওই কিশোর বাবার লাশ বহন করছে, দশদিনের মাথায় কাঁধে তুলল মায়ের মরদেহ।
গত ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিধ্বস্ত ফ্লাইটের প্রধান বৈমানিক ও বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আবিদ সুলতান মারা যান ১৩ মার্চ।
“১৩ মার্চ পিতার মৃত্যুর ধাক্কা দিয়ে শুরু, সেই শোকে ১৮ মার্চে মা আফসানা খানম স্ট্রোক করেন। মাকে হাসপাতালে রেখে পরদিন (১৯ মার্চ) বাবার লাশ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মাহী। এরপর আজ (২৩ মার্চ) মায়ের মৃত্যু। একের পর এক এসব চাপে মাহী যেন পাথর হয়ে গেছে,” বেনারকে জানান মাহীর ছোট চাচা খুরশিদ মাহমুদের স্ত্রী মৌসুমী।
আফসানা খানম ঢাকার আগারগাঁওয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মারা যান। হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের কর্মকর্তা ডা. কাজী একরাম হোসেন এই খবর নিশ্চিত করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আফসানার মস্তিষ্কে দুবার রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) হয়েছিল। প্রথমবার ছিল মৃদু, পরেরটি গুরুতর।”
এর আগে হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “মস্তিস্কে অস্ত্রোপচার করার পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।”
আফসানার মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে প্রথম তাঁদের উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ বিদায় জানাতে আসা স্বজন-বান্ধবদের কান্নায় এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রয়াত আফসানার বান্ধবী ইয়াসমিন চৌধুরী শিউলি বেনারকে বলেন, “কেউ কাউকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।”
বিকেলে গাউসুল আজম জামে মসজিদে আফসানার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মাহীকে জড়িয়ে ধরে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় নির্বাক মাহীকে কাঁদতে দেখা যায়নি। সন্ধ্যায় বনানী সামরিক কবরস্থানে আবিদ সুলতানের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তাঁর স্ত্রী আফসানা।
প্রসঙ্গত, নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে তিনজনের মরদেহ গত বৃহস্পতিবার দেশে এসেছে। এর আগে ২৩ জনের মৃতদেহ ১৯ মার্চ দেশে আসে। সেদিন আর্মি স্টেডিয়ামে তাঁদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
মাহীও পাইলট হতে চাইত
“বাবা আবিদ সুলতান ও দাদা এম এ কাশেমের মতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল মাহীরও। ছোটবেলা থেকেই বলত সে পাইলট হবে,” বলেন মৌসুমী মাহমুদ তান্নি।
“কিন্তু নেপালের দুর্ঘটনার পর মাহীর মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, তিনি মাহীকে এই পেশায় যেতে দেবেন না।”
মৌসুমি জানান, মাহীর চার চাচার মধ্যে একজন আগেই মারা গেছেন। অন্য তিন জনের মধ্যে দুই জন ঢাকার পল্লবী এলাকায় থাকেন। এখন তাঁদের কাছে থেকেই বড় হবে আবিদ-আফসানার এই এতিম সন্তান। আগামী মে মাসে ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় অংশ নেবে ঢাকার মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ছাত্র মাহী।
আফসানা খানমের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাহীর স্কুলের বন্ধুরাও তার বাসায় ছুটে আসে। তাদেরই একজন শাহরিয়া জালাল মিম বেনারকে জানায়, “বাবার মৃত্যুর পর নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছিল মাহী। মায়ের মনে সাহস যোগাতে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল। বন্ধুরাও তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর সবাই ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।”
মিম জানায়, “বন্ধু মাহী একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। এমনিতে গাড়ি মাহীর খুব পছন্দের। তার বাসা খেলনা গাড়ি দিয়ে ভর্তি। তবে কেউ যখন তাকে জিজ্ঞাসা করত, তুমি কি হতে চাও? জবাবে সে বলত, পাইলট হবে। বাবার সাথে এক সাথে বসে বিমান চালাবে।”
উত্তরা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. হাসানুজ্জামান আকন্দ স্বপন বেনারকে বলেন, “আবিদ-আফসানা দীর্ঘদিন আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তারা খুবই মিশুক স্বভাবের হওয়ায় আশেপাশে সবার সাথেই তাঁদের সুসম্পর্ক ছিল। আমরা সবাই এখন মাহীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন।”
একসঙ্গে মা–বাবাকে হারানো এই কিশোরের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইলেন হাসানুজ্জামান।