যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় অগ্নিদগ্ধ ছাত্রীকে বিদেশ পাঠাবে সরকার

প্রাপ্তি রহমান
2019.04.08
ঢাকা
190408_Madrasa_student_1000.jpg যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় অগ্নিদগ্ধ নুসরাত জাহান রাফিকে ফেনীতে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ৬ এপ্রিল ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

শিক্ষকের শ্লীলতাহানি চেষ্টার প্রতিবাদ করে দুর্বৃত্তদের আগুনে পোড়া মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে দেখতে এসে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া সোমবার বিকেলে সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই উপ-দপ্তর সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী রাফিকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর চিকিৎসার সব খরচ সরকার বহন করবে। যেকোনো মূল্যে তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা করা হবে।”

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর অবস্থা যদি সিঙ্গাপুরে পাঠানোর মতো হয়, তাহলে যেন দ্রুত পাঠানো হয়। আমরা আজই মেয়েটির শারীরিক অবস্থার বিবরণ সিঙ্গাপুরে পাঠাচ্ছি।”

“সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে দ্রুততম সময়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে,” যোগ করেন তিনি।

ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভার চরচান্দিয়া গ্রামের রাফি গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তাঁর শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়।

মাদ্রাসা অধ্যক্ষের শ্লীলতাহানি চেষ্টার প্রতিবাদ করার জের ধরে তিনি এই অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার তাঁকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “মেয়েটি এসেছেই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়, শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।”

“সোমবার সকাল থেকে তাঁর তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করছে না। সে কারণে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে ‘ভেন্টিলেশন’ দেওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি।

দুইদিন পর মামলা

সোমবার রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান ফেনীর সোনাগাজী থানায় অজ্ঞাতনামা চার নারীসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলা মাদ্রাসার দপ্তরী নুরুল আমিনকে দিয়ে তাঁর বোনকে ডেকে পাঠান। অধ্যক্ষ আলিম পরীক্ষার আধাঘন্টা আগে প্রশ্নপত্র দেবেন এই কথা বলে তাঁকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেন।

ওই দিনই তাঁদের মা শিরিনা আক্তার বাদি হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর তদন্তকারী কর্মকর্তা অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠান।

এরপর থেকেই নানাভাবে তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। গত ৬ এপ্রিল সকাল পৌনে ১০ টার দিকে আরবী প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন রাফি। কক্ষে ঢুকে তিনি তাঁর প্রবেশপত্র রাখার পরপরই একজন বোরকা পরা মেয়ে তাঁকে এসে জানায়, নিশাত নামের তাঁর এক বান্ধবীকে ছাদে কেউ পেটাচ্ছে।

খবর শুনে তিনি মাদ্রাসার ভেতরের সাইক্লোন সেন্টারে তৃতীয় তলার ছাদে যান। সেখানে পৌঁছানোর পর মুখোশ, হাতমোজা ও বোরকা পরা অজ্ঞাতনামা চারজন তাঁকে মামলাটি তুলে নেওয়ার কথা বলেন।

ওই চারজনের দুজন নারী, অন্য দুজন নারী না পুরুষ তা বোঝা যায়নি। মামলা তুলতে রাজি না হওয়ায় চারজন তাঁকে ধরে টয়লেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে কেরোসিন গায়ে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

বাঁচার জন্য রাফি দৌড়ে দোতলায় নেমে এলে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ‘পাপোশ’ দিয়ে তাঁর আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।

মাহমুদুল সাংবাদিকদের বলেন, “সেদিনের ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর থেকে আমি নিজেই বোনকে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিতাম। সেদিন ফটকের নিরাপত্তারক্ষী আমাকে ঢুকতে দেয়নি।”

“ওর শরীরটা কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়ার পর মাদ্রাসার লোকজন ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পরে মাদ্রাসার এক শিক্ষক আমাকে ফোন করে জানায়,” বলেন তিনি।

ঘটনাস্থল থেকে রাফিকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে ‘মোবাইলে’ তাঁর বক্তব্য ‘রেকর্ড’ করেন মাহমুদুল।

রাফির ভাই আরো জানান, তাঁর মা মাদ্রাসা অধ্যক্ষের নামে মামলা করার পর থেকে নূর উদ্দিন, জাবেদ, শাহাদৎ হোসেন, শামীম, মহিউদ্দীন শাকিলসহ অনেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছিলেন। তাঁরা মানববন্ধনও করেছেন।

“আমার বোনের গায়ে যারা কেরোসিন ঢেলেছে তাদের সঙ্গে ওই আসামিদের যোগসাজস থাকতে পারে,” বলেন তিনি।

গ্রেপ্তার হয়নি দুর্বৃত্তরা

সরকারের একাধিক মন্ত্রী রাফিকে ঢামেক হাসপাতালে দেখতে গেলেও তাঁকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টাকারী কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, রোববার পর্যন্ত আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো চেষ্টা ছিল না, সোমবার থেকে তাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “খোদ পুলিশের মহাপরিদর্শক সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। উপ-মহাপরিদর্শক (অপারেশনস)-কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামি গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

এ ঘটনায় সোমবার পর্যন্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার এবং আরো পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মাদ্রাসার ইংরেজি প্রভাষক আফছার উদ্দিন (৩৩), আলিম পরীক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম (২২), মাদ্রাসার নৈশ প্রহরী মো. মোস্তফা (৩৮), অফিস সহকারী নুরুল আমিন (৫০), আলা উদ্দিন (২৫), সাইদুল ইসলাম (২১) ও জসিমউদ্দিন (৩০)।

এর মধ্যে আফছার ও আরিফুলকে সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বলেন, “যারা এই অপরাধ করেছে তাদের বিচারতো হবেই। তবে আমরা এখন তাঁর (রাফির) চিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি।

রাফির ডাইং ডিক্লারেশন

দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণ ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকদের বরাত বলছে, রোববার হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ দিয়েছেন রাফি। তাঁর এই বক্তব্য আদালতে গ্রহণযোগ্য।

দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে একজন চিকিৎসকের কাছে তিনি ওই বক্তব্য দেন। রাফি বলেন, “নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরা চার ব্যক্তি তাঁর ওপর হামলা চালায়। তাঁদের একজনের নাম শম্পা। ওই চারজন ওড়না দিয়ে তাঁর হাত বেঁধে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর বলে, যা, পালা এবার।”

উল্লেখ্য, সোমবার সকাল থেকে রাফি আর কথা বলতে পারছে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।