‘মোরাল পুলিশিং’-এর শিকার বাংলাদেশের নারীরা
2025.03.26
ঢাকা

অতি উৎসাহী এক শ্রেণির ইসলামপন্থী নারীদের লক্ষ্য করে ‘মোরাল পুলিশিং’ শুরু করেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতার সুযোগে নারীদের লক্ষ্য করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়েছে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। এসব ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তড়িৎ পদক্ষেপ নেবারও আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বেনারনিউজ গত এক মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যালোচনা করে এমন অন্তত বিশটি ঘটনার সত্যতা পেয়েছে-- যেখানে নারীকে প্রকাশ্যে পোশাক নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বেনারকে বলেন, “গত ৫ আগস্টের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এক শ্রেণির মানুষ যার যার চিন্তা চেতনার জায়গা থেকে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। ইসলামী দল সরাসরি না হলেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। কারণ তারাই নারী চলা-ফেরা ও পোশাক নিয়ে কথা বলছে।”
গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের ভয়াবহতা অতীতের সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিত্য দিনের চলাচলে অনিরাপদবোধ করছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেক নারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরুণা সিক্ত সাচী বেনারকে বলেন, বর্তমানে দেশে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলছে, বিশেষ করে মেয়েদের ওপরে যে আঘাতগুলো আসছে সেটা মেনে নিতে পারছি না।
“আমি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে নিরাপদবোধ করছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই জায়গা যেখান থেকে দেশের সকল পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। সেখানেই যদি আমি অনিরাপদ বোধ করি তাহলে নারীরা নিরাপদ কোথায়?”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মেও নারীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে উল্লেখ অরুণা সিক্ত বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেটা হচ্ছে সেটা খুবই ওয়ার্নিং একটা সিচুয়েশন। এক একটা পোস্টের কমেন্টে তাদের মানসিকতা দেখে মনে হয় এরা একেকটা ভবিষ্যৎ ধর্ষক। আমি যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে বুঝাতে যাই যে ধর্ষণ পোশাক বা শালীনতার কারণে হচ্ছে না, তখন আঘাত আসে ধর্মীয়ভাবে।”
একটা মেয়ে যেই ধর্মেরই হোক যে অবস্থানেই থাকুক তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী।

‘নিরাপদ অনুভব করছি না’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শাঁওলী সামরিজা বেনারকে বলেন, "সম্প্রতি এই বিশ্বিবিদ্যালয়ের একজন নারী নিপীড়ককে গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে এনে সমাজে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, ওই নিপীড়ক সঠিক ছিল।”
তিনি বলেন, “আমি সমাজে মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারছি না। কারণ আমার সারাক্ষণ ভাবতে হয়, আমার দিকে কেউ আড়চোখে তাকাচ্ছে কি না। তাই স্বাভাবিক চলাফেরায় আমি নিরাপদ অনুভব করছি না।"
উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর পোশাক নিয়ে মন্তব্য করে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে মোস্তাফা অর্ণব অরণ্য নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় তৌহিদী জনতার ব্যানারে একদল মানুষ অভিযুক্ত অর্ণবকে থানা থেকে ছাড়াতে রাতভর থানা ঘিরে রাখে। পরদিন সকালে আদালত তাঁকে জামিন দেবার পরে তৌহিদী জনতা অর্ণবকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে। অভিযোগকারী ছাত্রীও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন।
এর আগে গত ১০ মার্চ পোশাক নিয়ে নারীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে সাভার থেকে খালিদ মাহমুদ ওরফে হৃদয় খান নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলা পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশকিছু ভিডিও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খালিদ বিভিন্ন সময় মেয়ে-শিশু-কিশোরী ও নারীদের পথ আটকে নানা আপত্তিকর কথা বলছেন। কী ধরনের পোশাক পরা উচিত, সে বিষয়ে পথ আটকিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবীর বেনারকে বলেন, “বেশ কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর ওই যুবককে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। ওই ব্যক্তি সাভার ও বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্কুল-কলেজের মেয়েদের টিজ (উত্যক্ত) করেন, হেনস্তা করেন, পোশাক নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেন। পরে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি।”
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে নারী বাইকারের সংখ্যা বেড়েছে। তাঁদের একজন সুরাইয়া জাহান বেনারকে বলেন, সম্প্রতি নিজের সন্তানকে স্কুল থেকে আনার পথে একজন মুসুল্লি আমার পথ আটকে নারী হয়ে কেন বাইক চালাচ্ছি তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এমনকি আমি যাতে বাইক না চালাই বরং বাইকার হিসেবে স্বামীকে সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেন। যা আমাকে বিব্রত করে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইসরাত হাসান বেনারকে বলেছেন, এসব ঘটনা (মোরাল পুলিশিং) স্পষ্ট সংবিধানের লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলার পরিপন্থী। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা নারীর নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিলে ঘটনার মাত্রা কমে আসবে।"
মোরাল পুলিশিংয়ের ঘটনা শুধু নারীর পোশাকেই সীমাবদ্ধ নয়, সম্প্রতি খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণের ওপর ক্ষুব্ধ ইসলামপন্থীদের মাঠে আক্রমণের পর এ বছর বেশ কয়েকটি মহিলা ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়েছে।
এছাড়া দেশের তিনজন প্রখ্যাত অভিনেত্রী পরী মনি, মেহজাবিন ও অপু বিশ্বাসকে দেশের পৃথক তিনটি স্থানে বিভিন্ন শোরুম উদ্বোধনে বাধা দেয় হেফাজতে ইসলাম, তৌহিদী জনতাসহ স্থানীয় মুসুল্লিরা।
‘কোথাও কিছু খেতে ভয় পাই’
রমজানে দিনের বেলায় খাবারের দোকান খোলা রেখে এবং খাবার খেতে গিয়ে অনেকেই হামলা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
গত ১২ মার্চ লক্ষ্মীপুরের একটি ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে দিনের বেলায় রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ায় বৃদ্ধসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করাতে দেখা গেছে। এর আগে, নোয়াখালীর হাতিয়াতেও একদল ব্যক্তিকে পুলিশের মতো বাঁশি বাজাতে বাজাতে গিয়ে খাবারের দোকান বন্ধ করতে এবং হুমকি-ধামকি দিতে দেখা যায়।
রমজান মাসে কায়িক শ্রমের সঙ্গে জড়িত অনেকেই রোজা রাখতে পারেন না। বিশেষ করে রিকশা, সিএনজি চালক ও শ্রমজীবী মানুষ এ সময়ে বিশেষ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই সিএনজি অটোরিকশাচালক বেনারকে বলেন, “ঢাকার গরম, ধুলাবালি ও যানজটের কারণে প্রচুর পানি খেতে হয়। এ জন্য রোজা রাখতে পারি না। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি বাইরে কোথাও কিছু খেতে ভয় পাই।”
এসব বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক বেনারকে বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোরাল পুলিশিংয়ের এমন অনেক ঘটনায় পুলিশ উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে। কোথাও কোথায় অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া কেউ অভিযোগ দিলে পুলিশ অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।”
এদিকে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যারা নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা, নারীকে খাটো করে রাখার প্রবৃত্তি ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এ সময় ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তার মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সবচাইতে বেশি। গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা দুঃসাহসিক ভূমিকা রেখেছে। দেশে বিরাজমান বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও বৈষম্য নিরসনে আমাদের প্রত্যেককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।