নুসরাতকে যৌন নিপীড়ন মামলার বিচার শুরু

জেসমিন পাপড়ি
2019.08.05
ঢাকা
190805_nusrat_Follow_up_620.jpeg যৌন হয়রানির মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষে আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে কারাগারে নেওয়া হয়। ৫ আগস্ট ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

ফেনীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় করা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছ আদালত। এর মধ্য দিয়ে হত্যা মামলার পরে এবার এই মামলাটিরও বিচার শুরু হলো।

সোমবার ফেনীর নারী ও শিশুনির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মামুনুর রশিদ এই আদেশ দেন। পাশাপাশি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২৭ অক্টোবর দিন ঠিক করেছে আদালত।

একই আদালতে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যা মামলাও চলছে। এদিন ওই মামলায়ও বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

হত্যা মামলার অগ্রগতি এবং এর পাশাপাশি যৌন নিপীড়নের বিচার কাজও শুরু হওয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহত নুসরাতের পরিবার।

নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বেনারকে বলেন, “যেভাবে বিচার কাজ এগিয়ে চলছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। আশা করি দ্রুত নুসরাত হত্যার সাথে জড়িতরা শাস্তির মুখোমুখি হবে।”

দুটি মামলাতেই বাদী পক্ষের হয়ে লড়ছেন আইনজীবী শাহজাহান সাজু। তিনি বেনারকে বলেন, আশা করছি আগস্ট মাসের মধ্যেই নুসরাত হত্যা মামলাটির বিচার নিষ্পত্তি হবে।”

তিনি বলেন, “যৌন নিপীড়ন মামলার বাদী নুসরাতের মা। তিনি হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে স্ট্রোক করে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাই আমরা আদালতের কাছে সময় চেয়েছি, যাতে সাক্ষ্য গ্রহণ দেরিতে শুরু হয়।”

“যৌন নিপীড়নের মামলাটি নারী নির্যাতনের আইনের ১০ ধারার মামলা। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের জেল। অন্যদিকে হত্যা মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমরা আসমির বিরুদ্ধে হত্যা মামলাটি দ্রুত এগিয়ে নিতে চাই,” বলেন শাহজাহান সাজু।

মামলার অগ্রগতি বিষয়ে তিনি বলেন, “তদন্ত কর্তৃপক্ষ ৯২ জনকে সাক্ষী করেছিল। আজ পর্যন্ত ৭৫ জনকে আদালতে উপস্থাপন করতে পেরেছি। আগামী কাল আরও ছয়জনের সাক্ষ্য নেবে আদালত।”

“আশা করি আদালতে ন্যায় বিচার পাব। অপরাধীদের শাস্তি হবে,” বলেন বাদী পক্ষের এই আইনজীবী।

উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে।

নুসরাত বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করে। পরে তার মা বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেদিনই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

এরপর থেকে ওই মামলা প্রত্যাহার করতে রাফি ও তার পরিবারকে চাপ দিতে থাকে অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা।

গত ৬ এপ্রিল নুসরাত পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে কৌশলে তাকে একটি ভবনের ছাদে নিয়ে গিয়ে বোরকা পরা পাঁচ ব্যক্তি মামলা তোলার জন্য একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে। নুসরাত আস্বীকৃতি জানালে ওই পাঁচ ব্যক্তি প্রথমে তার হাত পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।

মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত গত ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যায়।

গত ৩ জুলাই যৌন নির্যাতন মামলায় অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম। এ মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে একমাত্র আসামি। এ মামলায় বাদীপক্ষের সাক্ষী ১৮ জন।

অন্যদিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় আটক রয়েছেন এজাহারভুক্ত আটজনসহ ২১ জন। এদের মধ্যে সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১২ জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

প্রতিহিংসামূলক মামলা: আসামিপক্ষ

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফরিদ উদ্দিন খান নয়ন বেনারকে বলেন, “অধ্যক্ষ সিরাজ দাবি করেছেন, তিনি নুসরাতসহ কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীকে শাসন করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে শায়েস্তা করার জন্যই প্রতিহিংসামূলকভাবে এই যৌন নিপীড়নের মামলা করা হয়েছিল। ”

“অধ্যক্ষ সিরাজ এই প্রতিষ্ঠানে ২০ বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বা এ ধরনের কোনো অভিযোগ ওঠেনি,” বলেন সিরাজের আইনজীবী।

ফরিদ উদ্দিন বলেন, “তাছাড়া তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এমন বয়সে এ বাচ্চা বয়সী একটি মেয়েকে যৌন নিপীড়ন করার অভিযোগ কেন করা হলো সেটা দেখার বিষয়।”

যৌন নির্যাতন মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নুসরাতের দেওয়া জবানবন্দি রয়েছে বলে জানান তার আইনজীবী শাহজাহান সাজু।

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফরিদ উদ্দিনের দাবি, “নুসরাতের জবানবন্দির সাথে তার মায়ের করা মামলার বর্ণনায় গরমিল রয়েছে। ”

জামিন আবেদন করেছেন ওসি মোয়াজ্জেমের

যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করতে গিয়ে নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দির ভিডিও রেকর্ড ও তা ইন্টারনেটে ছড়ানোর ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন উচ্চ আদালতে আবারও জামিন আবেদন করেছেন।

গত সপ্তাহে উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনটি করা হয়েছে বলে জানান তাঁর আইনজীবী রানা কাওছার।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, “কাল অথবা পরশু হাই কোর্টের যেকোনো অবকাশকালীন বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে।”

“আদালত শুনলে শুনানি হবে অন্যথায় অবকাশের পর নিয়মিত বেঞ্চে এর শুনানি হতে পারে,” বলেন তিনি।”

এর আগে গত ৯ জুলাই এই পুলিশ কর্মকর্তার জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।

গত মার্চে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে নুসরাত যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম তাকে (নুসরাত) থানায় ডেকে জবানবন্দি নেন। পরে নুসরাতের মৃত্যু হলে ওসির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ওঠে। তারই মধ্যেই ওই জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

পরে ঢাকায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আইনজীবী সৈযয়দ সায়েদুল হক সুমন। পিবিআই তদন্ত করে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে নুসরাতের জবানবন্দি ভিডিও করে যে তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ পায়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

গত ১৬ জুন উচ্চ আদালতে আগাম জামিন আবেদন করেন ওসি মোয়াজ্জেম। পরদিন সুপ্রিম কোর্ট এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।