আসামিদের উপস্থিতিতে আদালতে নুসরাত হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ
2019.06.10
ঢাকা

ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছে। সোমবার বাদী মাহমুদুল হাসান আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতকে এই অভিযোগপত্র সম্পর্কে তাঁর অনাপত্তির কথা জানান।
নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ অভিযোগ গঠনের তারিখ নির্ধারণ করেছেন আগামী ২০ জুন। তা ছাড়া অভিযোগপত্রভুক্ত নন কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এমন পাঁচ আসামিকে অব্যাহতিও দিয়েছেন তিনি।
মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান বলেন, অভিযোগপত্র নিয়ে তিনি তাঁর সন্তুষ্টির কথা আদালতকে জানিয়েছেন।
“অভিযোগপত্র নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। যে পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাদের ব্যাপারেও আমার কোনো অভিযোগ নেই,” মাহমুদুল হাসান বেনারকে বলেন।
সোমবার পুলিশ নুসরাত হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার ২১জনকে আদালতে হাজির করে। আসামিদের বহনকারী গাড়িতে ফেনীর স্থানীয় নাগরিকেরা ইটপাটকেল ছুড়ে ঘৃণা জানায়। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানকে পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। তারা মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে নুসরাত যে মামলা করেছিল, সেটি প্রত্যাহারে চাপ দিয়েছিল। তাদের কথা না শোনায় হাত–পা বেঁধে পুড়িয়ে ফেলা হয় নুসরাতকে। এর পাঁচদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত।
নুসরাত ইস্যুতে মামলা হয়েছে দুটি। একটি হত্যা মামলা ও আরেকটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলা। সোনাগাজী থানায় শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে গেলে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতের ভিডিও ধারণ করেন ও ছড়িয়ে দেন। মোয়াজ্জেম ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি ও পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারে পুলিশের গড়িমসি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
পাঁচজনকে অব্যাহতি, ছয়জনের জামিন না মঞ্জুর
সোমবার পুলিশ এক এক করে গ্রেপ্তারকৃত ২১ আসামিকে আদালতে উপস্থাপন করে। আদালত আসামিদের উপস্থিতি যাচাই শেষে অভিযোগপত্র সম্পর্কে বাদীর মতামত জানতে চান। বাদী অনাপত্তি দিলে শুরু হয় বাকি কার্যক্রম।
আদালত যে পাঁচজনকে অব্যাহতি দিয়েছে তাঁরা হলেন, নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্যাহ, মো. আলাউদ্দিন ও শাহিদুল ইসলাম।
আসামিদের ছয়জন গতকাল জামিন প্রার্থনা করেন। তাঁরা হলেন, আওয়ামী লীগ নেতা মো. রুহুল আমিন, কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, প্রভাষক আফছার উদ্দিন, মাদ্রসাছাত্র ইফতেখার উদ্দিন রানা, মো. শামীম ও নুর উদ্দিন। তাঁদের পক্ষে আদালতে দাঁড়ান আইনজীবী গিয়াসউদ্দীন। আদালত ওই ছয়জনের জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়।
ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি দায়েরের বিরোধিতা করেন আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন। এজলাস থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
“মামলাটি এ আদালতে বিচার্য নয়। যাঁরা নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছিলেন সেই পাঁচজন ছাড়া বাকি সব আসামিকে জামিন দেওয়া উচিত,” গিয়াসউদ্দীন বলেন। তিনি আরও বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
অভিযোগপত্র গ্রহণ শেষে আদালত চার্জ গঠনের তারিখ ঘোষণা করেন। আগামী ২০ জুন চার্জ গঠন হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গ ওসি মোয়াজ্জেম
গত ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন সোনাগাজী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
গত ২৭ মার্চ নুসরাত সোনাগাজী থানায় মাদ্রসা অধ্যাক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানান। সে সময় ওসি তাঁকে আপত্তিকর নানা প্রশ্ন করেন ও ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ।
তদন্ত শেষে গত ২৭ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ঢাকার সাইবার ট্রাইবুনালে অভিযোগপত্র জমা দেয়। ওইদিনই আদালত মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করে। এর দুদিন পর মোয়াজ্জেম হোসেন আগাম জামিন প্রার্থনা করেন হাইকোর্টে।
শুরু থেকেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হাতে পাওয়া নিয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নেয় ফেনীর পুলিশ কর্তৃপক্ষ। এরপর তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল রংপুর রেঞ্জও তাঁর কোনো হদিস দিতে পারেনি। সোমবার পর্যন্ত মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এর মধ্যে রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক দেবদাস ভট্টাচার্যের বক্তব্য থেকে জানা যায় মোয়াজ্জেম পালিয়ে গেছেন। দেশের শীর্ষ বাংলা দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “মোয়াজ্জেম কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে অনুপস্থিত। তিনি বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত। তবে পরোয়ানা আমরা হাতে পেয়েছি।”
খবরটি প্রকাশের পর পুলিশ প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার মন্ত্রণালয়ে মত বিনিময় সভায় বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি রয়েছে এ বিষয়ে, আসামি ছাড় পাবে না।
“পালিয়ে গেলে ধরা তো কঠিন। সময় লাগে। তবে সরকার এ ব্যাপারে সিরিয়াস। কোনো শৈথিল্য দেখানো হবে না,” ওবায়দুল কাদের বলেন।
এর আগে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, অপরাধের সঙ্গে যে–ই জড়িত থাকুক, তাকে শাস্তি পেতে হবে, সে ওসি হোক কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হোক আর জনপ্রতিনিধি হোক। তিনি আরও বলেন, ওসি এখন পালিয়ে থাকলে খুঁজে পেতে হয়তো একটু সময় লাগবে। তবে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।
মামলার বাদী সাইয়েদুল হক সুমন বেনারকে বলেন, পুলিশ মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করলে, বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হবে। না হলে তাদের জন্য বিষয়টি সুখকর হবে না।
“আমি মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বলি পুলিশ যদি কষ্ট করে মোয়াজ্জেমকে ধরতে না পারে, আপনারা ধরে পুলিশে সোপর্দ করুন,” সাইয়েদুল বলেন।
পুলিশ কেন গড়িমসি করছে? জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বেনারকে বলেন, পুলিশ মহাপরিদর্শক বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
“অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক, যেকোনো সময় গ্রেপ্তারের খবর পাবেন,” সোহেল রানা বলেন।
আসামি যারা
গত ২৮ মে ঢাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নুসরাত হত্যা মামলার অভিযোগপত্র সম্পর্কে গণমাধ্যমকে অবহিত করেন সংস্থাটির প্রধান (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার।
ওই সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই জানায়, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচজনের পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে বিভিন্নভাবে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁদের আসামি করা হয়েছে। মোট আসামির সংখ্যা ১৬।
এরা হলেন- এসএম সিরাজ উদদৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), মাকসুদ আলম কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০), রুহুল আমিন (৫৫), ও মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।
অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা কারাগারে থেকেই নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। এ জন্য তাঁকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
নুসরাতকে হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় তার তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন এবং তাঁদের সাথে শাহাদাত হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ নামে আরো দুজন।
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার সোমবার বেনারকে বলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
“আগুনে পুড়িয়ে হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের এই দণ্ড এড়ানোর সুযোগ নেই,” ফাহমিদা বলেন।