স্বামীকে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেছেন মিন্নি: পুলিশ
2019.07.18
ঢাকা

জুনের শেষ সপ্তাহে স্বামী রিফাত শরীফ (২৫) খুন হয়েছেন সাবেক প্রেমিকের হাতে। পাঁচ দিন পর সেই প্রেমিক সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ডও (২৫) মারা গিয়েছেন কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’।
উপকূলীয় জেলা বরগুনায় যাকে ঘিরে এত নাটকীয়তা, সেই আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি (২০) নিজেই স্বামীকে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার পরদিনই বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে এ তথ্য জানালেন জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন।
“মিন্নি আমাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আমাদের কাছেও প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত,” বলেন এসপি।
যদিও মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বেনারকে বলেন, “মিন্নির উপর ‘টর্চারিং’ চলছে। আপনাদের বুঝতে হবে কতটা ‘টর্চার’ করা হলে সে একদিনের মধ্যে এমন কথা বলতে বাধ্য হতে পারে। রিফাতকে কারা খুন করেছে তার ভিডিও আছে, অথচ দোষী করা হচ্ছে আমার মেয়েটাকে।”
অন্যদিকে এসপির বক্তব্য, “মিন্নি হত্যা পরিকল্পনায় অংশ নেন। শুরু থেকেই তিনি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার আগে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই তিনি করেছেন। হত্যাকারীদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।”
“এসবই বানানো কাল্পনিক গল্প। এগুলো আমার একদমই বিশ্বাস করি না,” উল্লেখ করে মিন্নির বাবা বলেন, “পুলিশ যা বলছে, আমি তাঁর তীব্র নিন্দা জানাই।”
“আমার মেয়ে জীবনবাজি রেখে তাঁর স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে পারেনি। ওই ঘটনার পর সে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। এমন মানসিক অবস্থায়ই তাঁকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হলো,” যোগ করেন তিনি।
এসপি বলেন, “মিন্নি স্বীকার করেছেন বলেই বিষয়গুলো আদালতের কাছে তুলে ধরে আমরা সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রিমান্ড আবেদন করেছি এবং আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।” সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো জানান, একাধিক আসামি আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারিক আদালতের রায় না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মিন্নি নিস্পাপ। পুলিশের তাঁকে এভাবে অপরাধী বলার কোনো সুযোগ নেই।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরাফাত হোসেন খানও বেনারকে বলেন, “এ জাতীয় ‘স্পর্শকাতর’ মামলাগুলোয় পুলিশের দায়িত্বশীলতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে তদন্তের কতটুকু তারা জনসম্মুখে প্রকাশ করবে সে ব্যাপারে তাদের অনেক বেশিসর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।”
“মিডিয়াতে যদি আগে থেকেই একটি ধারণা দিয়ে দেওয়া হয় যে এই ব্যক্তি অভিযুক্ত তাহলে আসল বিচার প্রক্রিয়ায় একটি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা বিচারকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে বাধা তৈরি করে,” যোগ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই শিক্ষক।
মিন্নির বাবার দাবি, “মূল আসামিদের বাঁচানোর জন্য আমার মেয়েকে ফাঁসানো হয়েছে।” যদিও এসপি বলছেন, “ঘটনায় অভিযুক্ত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”
গত ২৬ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত রিফাত হত্যাকাণ্ডের একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেলে সারাদেশে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। পরদিনই নিহতের বাবা দুলাল শরীফ বাদি হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা সাতজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
এরপর ২ জুলাই পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মামলার প্রধান আসামী নয়নের মৃত্যু, ১৩ জুলাই পুত্রবধুকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মামলার বাদির সংবাদ সম্মেলন, পরদিনই মিন্নির পাল্টা সংবাদ সম্মেলনসহ প্রায় প্রতিদিনই ঘটনার নাটকীয় মোড় জনমনের চাঞ্চল্য ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে।
যেভাবে রিমান্ডে মিন্নি
মামলার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রধান সাক্ষী হিসাবে পুলিশ লাইনে ডেকে এনে মঙ্গলবার দিনভর সাক্ষ্যগ্রহণের পর রাত নয়টায় মিন্নিকে আসামি হিসাবে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। পরদিন দুপুরে তাঁকে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে হাজির করে সাতদিনের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।
বরগুনা থানার এই পরিদর্শক (তদন্ত) আদালতকে বলেন, “মিন্নি ঘটনার আগের দিন (২৫ জুন) নয়ন বন্ডের বাড়িতে গিয়ে এ হত্যার পরিকল্পনা করে।” শুনানিকালে বুধবার আদালতে তাঁর পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।
বিচারক সিরাজুল ইসলাম গাজী কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মিন্নির কিছু বলার আছে কি না জানতে চাইলে মিন্নি আদালতের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “আমি আমার স্বামী রিফাত হত্যার বিচার চাই।” এ সময় তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে মামলার ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয়ের জবানবন্দি পেশ করেন, যেখানে রিফাত হত্যার ঘটনায় মিন্নি জড়িত কথা উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া ঘটনার আগে নয়ন বন্ড, রিফাতসহ অন্য আসামিদের সঙ্গে মিন্নির মুঠোফোন আলাপের তথ্যও আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এসব ব্যাপারে বিচারক মিন্নির কাছে জানতে চাইলে তিনি নীরব ছিলেন। শুনানিকালে উপস্থিত থাকা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সঞ্জিব দাস স্থানীয় সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, “মিন্নির বক্তব্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না বলেই আদালত তাঁর পাঁচ দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।”
তবে মিন্নির বাবার অভিযোগ, বিচারকের উপস্থিতিতে আইনজীবী গোলাম সরোয়ার নাসির, জিয়া উদ্দিন ও আব্দুল কাদের তাঁর মেয়ের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। বিধি অনুযায়ী ওকালতনামায় স্বাক্ষর না থাকায় আদালত তাঁদের বক্তব্য শুনতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
“একটি কুচক্রী মহল মামলাটাকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে। বরগুনার প্রভাবশালী মানুষরা এর সাথে জড়িত, যে জন্য আজ আমার এই পরিণতি। তারা মোটা অঙ্কের টাকা ছড়িয়ে সবাইকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে গেছেন,” বেনারকে বলেন তিনি।
তাঁর অভিযোগ, ওই প্রভাবশালী মহলের চাপেই তাঁর মেয়ের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী দাঁড়াতে পারেনি।
এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সালমা আলী বেনারকে বলেন, “সংবিধানের ৩১ ও ৩৩ অনুযায়ী কাউকেই আইনের আশ্রয়লাভ বা আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এমনকি কেউ অপরাধ স্বীকার করলেও আইনগত সহায়তা পাবে। তিনি আইনজীবী না পেলে সরকার তা নিয়োগ করবে।”
“এক্ষেত্রে সরকারি কৌঁসুলিদেরও দায়িত্ব রয়েছে,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী।
তবে ব্যারিস্টার আরাফাত বলেন, “আসামির পক্ষে কোনো উকিল বা কোনো আইনজীবী না থাকলে রিমান্ড দেয়া যাবে না এমন কোনো বিধান আসলে নাই| রিমান্ড মঞ্জুর করার ব্যাপারে আসামী পক্ষে আইনজীবী আছে কি নাই সেটা আসলে অতটা গুরুত্ব পায় না|”
উল্লেখ্য, ওই এলাকার সংসদ সদস্যের আইনজীবী পুত্র সুনাম দেবনাথ গত ২৭ জুন তাঁর ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “আমরা বরগুনার আইনজীবীরা রিফাত শরীফ হত্যাকারীদের কোনো আইনি সহায়তা দিব না, একজনকেও না। আশা করি, আমার এই প্রস্তাবের সাথে সব আইনজীবী একমত হবেন।”
রিফাত হত্যা মামলায় মিন্নিসহ মোট ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এখন পর্যন্ত ১০ আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।