বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যার দায়ে স্ত্রী মিন্নিসহ ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড

জেসমিন পাপড়ি
2020.09.30
ঢাকা
200930_BARGUNA_Rifat_Murder_1000.jpg বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর জামিনে থাকা রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে (মাঝখানে সাদা ওড়না ও সাদা মাস্ক পরা) আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[নিউজরুম ফটো]

বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। বাকি চার আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডের ১৫ মাস পর বুধবার বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ছয় আসামির প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। এদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জনের বিচার চলছিল এই আদালতে।

মিন্নি (২১) ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি পাঁচজন হলেন রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি (২৩), আল কাইউম ওরফে রাব্বি আঁকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম ওরফে সিফাত (১৯), রেজওয়ান আলী খান ওরফে টিকটক হৃদয় (২২) ও মো. হাসান (১৯)।

তবে সাজাপ্রাপ্তদের বয়স বিবেচনা করে তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া যেত বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট সালমা আলী।

তিনি বেনারকে বলেন, “মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বয়স মাত্র ১৯ থেকে ২৩ বছর। মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেওয়া যেত। যদিও সেই পরিবেশ আমাদের দেশর কারাগারগুলোতে নেই। এটা আমাদের একটা বড়ো ব্যর্থতা।”

তাঁর মতে, “রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনা রাজনৈতিক মদদে নষ্ট হয়ে যাওয়া তরুণ সমাজের এক খণ্ডচিত্র। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে খুনি নয়ন বন্ড বা রিফাত ফরাজিদের জন্ম হয়।”

“এই অল্পবয়সী তরুণদের শাস্তি হলেও যাদের মদদে তারা এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো,” বলেন সালমা আলী।

গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী মিন্নির সামনে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সন্ত্রাসীরা। রিফাতকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেদিন বিকেলে তিনি মারা যান।

পরের দিন বরগুনা থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ। এ মামলায় মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়।

ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নজরে নিয়ে মামলার পর দিন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরে অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে আরো ২৩জনের সাথে মিন্নির নামও যুক্ত করে পুলিশ। এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

গত ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বরগুনার শিশু আদালত। এদিন থেকেই আবার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এই ১০ আসামির বিরুদ্ধে ৭৬ জন সাক্ষ্য দেন।

রিফাতের বাবা সন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ মিন্নির বাবা

সন্তান হত্যার রায় পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ।

টেলিফোনে বেনারকে দুলাল শরীফ বলেন, “আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। তবে রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি মিলবে না।”

তিনি বলেন, ১৫ মাস ধরে আমি ও আমার পরিবার কাঁদছি। আমরা এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আশা করব এই রায় দ্রুত কার্যকর হবে।”

তবে মিন্নিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাঁর বাবা মোজাম্মেল হোসেন। তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে দাবি করে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথাও জানান তিনি।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মিন্নির বাবা সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বিক্ষুব্ধ। আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার। আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।”

তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) ভুবন চন্দ্র হালদার সাংবাদিকদের বলেন, আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন যে, রিফাত হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় তাঁর স্ত্রী মিন্নি যুক্ত ছিলেন। তাঁরই পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে।”

মিন্নি কারাগারে

জামিনে থাকা নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নি রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। কারাগারে থেকে বাকি আসামিদেরও এ সময় আদালতে হাজির করা হয়।

তবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় দণ্ডিত বাকি আসামিদের মতো মিন্নিকেও আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান বাবু।

তিনি বলেন, “রায় ঘোষণার পরপরই মিন্নিকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যান্যদের সাথে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।”

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি

রায় ঘোষণার সময় আদালত জানায়, মিন্নিসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের নির্মম বর্বরতা ও নির্মমতা মধ্যযুগীয় কায়দায়কেও হার মানিয়েছে। ওই নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারী আসামিরা প্রত্যেকে যুবক। তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুবসমাজসহ দেশে-বিদেশের সব বয়সের মানুষ তাঁদের ওই নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছে।”

“এমতাবস্থায় এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তাঁদের অনুসরণ করে অন্য যুবকরাও ধ্বংসের পথে যাবে। এসব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়,” বলেন বিচারক।

অন্যদিকে রিফাত হত্যা মামলার রায় দেশের অন্যান্য আলোচিত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

বুধবার এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায় নিঃসন্দেহে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।