টেকনাফে প্রশ্নবিদ্ধ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চলছেই, দুই মাসে নিহত ২২
2019.03.01
ঢাকা ও কক্সবাজার

মাদকবিরোধী অভিযানে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গত দুই মাসে অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছেন। যদিও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এভাবে ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যায় মাদক ব্যবসা বন্ধ হবে না।
ইয়াবার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত মিয়ানমার সীমান্তের ওই উপজেলায় পুলিশ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুক্রবার ভোরে চার মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন।
টেকনাফ থানার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২২ জন। এই সময়ে কক্সবাজার জেলায় বন্দুকযুদ্ধে মোট ২৫ জন নিহত হয়েছেন।
জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর শুধু কক্সবাজারে এখন পর্যন্ত ৬১ জন নিহত হয়েছেন।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, “ইয়াবা প্রবেশের মূল পয়েন্ট টেকনাফ। ওই সীমান্তে সক্রিয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেশি। যে কারণে মাদক বিরোধী অভিযানে সেখানে যেকোনো এলাকার চেয়ে বেশি ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হচ্ছে।”
অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘আত্মরক্ষার্থে’ ছোঁড়া গুলিতে মাদক কারবারিরা নিহত হচ্ছেন বলে দাবি করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০১৮ সালের প্রথম দশ মাসে সারা দেশে ৪৩৭টি বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার ঘটনা রেকর্ড করেছে।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৯২ জন নিহত হয়েছেন। তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, এই অভিযান শুরুর পর নিহতের সংখ্যা তিনশ পার হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বা ব্যবসায়ীরা নির্মূল হবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই।”
“বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে, কিন্তু মাদক ব্যবসা বন্ধ বা সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়,” যোগ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই সাবেক নির্বাহী পরিচালক।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের সামনে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফের ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। ধারণা করা হয়েছিল, এই উদ্যোগের পর টেকনাফে মাদক ব্যবসা বন্ধ হবে, নিহতের সংখ্যাও কমবে।
যদিও লিটনের অভিমত, “মাদক ব্যবসার সাথে শুধু কয়েকজন ব্যবসায়ী জড়িত নয়, এর নেপথ্যে ক্ষমতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অতএব ‘বন্দুকযুদ্ধ’ মাদক বন্ধের একমাত্র সমাধান হতে পারে না।”
“জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করা, উৎসমূল বন্ধ করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব,” মনে করেন লিটন।
তাঁর মতে, আইনী প্রক্রিয়ার বাইরে মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ কখনোই মঙ্গলজনক নয়।
এক দিনে নিহত চার
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং এলাকায় শুক্রবার ভোরে পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরী পাড়ার আব্দুল জলিলের ছেলে নজির আহমদ (৪০) ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নয়াপাড়ার মোহাম্মদ জাকারিয়ার ছেলে গিয়াস উদ্দিন (৩০)।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বেনারকে জানান, হোয়াইক্যংয়ের নয়াপাড়ার বটতলীতে ইয়াবা বিক্রির খবর পেয়ে অভিযানে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা।
“আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়,” বলেন তিনি।
একই সময়ে সাবরাং এলাকায় বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন সদর ইউনিয়নের ডেইল পাড়ার কালু মিয়ার ছেলে আব্দুল শুক্কুর (৫০) ও তাঁর ছেলে মোহাম্মদ ইলিয়াছ (৩০)।
বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুদ জামান চৌধুরী বেনারকে জানান, সাবরাং ইউনিয়নের পুরানো মগপাড়া কাকঁড়া প্রজেক্ট দিয়ে ইয়াবার চালান প্রবেশের সংবাদ পেয়ে একটি টহলদল ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা গুলি করে।
“আত্মরক্ষার্থে বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়,” বলেন তিনি।
গত দুই মাসের ‘বন্দুকযুদ্ধ’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ভোরে টেকনাফের খারাং খালি তিন নম্বর স্লুইস গেইট এলাকায় বিজিবির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিল্লাল হোসেন (৩৮) নামে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন।
২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে দমদমিয়ায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নুরুল আলম (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা, তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ থাকার কথা বলেছে র্যাব। একই দিন সাবরাংয়ের কাটাবুনিয়ায় বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বেল্লাল হোসেন (২৫) নামে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন।
এ ছাড়া পাঁচ নম্বর স্লুইট গেইট এলাকায় ২০ ফেব্রুয়ারি একইভাবে মারা যান মোহাম্মদ জাফর আলম (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা, যার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ আনা হয়।
মহেশখালীর কালমাদিয়া নামক স্থানে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শাহাব উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি নিহত হন।
গত ২৮ জানুয়ারি নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত হন মাদক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (২০) ও মোহাম্মদ রফিক (৫৫)।
এর আগে ২৪ জানুয়ারি টেকনাফে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই জন ইয়াবা ব্যবসায়ী এবং মহেশখালীতে পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক ডাকাত নিহত হন।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সামছু পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ২১ জানুয়ারি।
টেকনাফ পৌরসভার উত্তর জালিয়াপাড়ায় ২০ জানুয়ারি বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমদ ওরফে মুছু (৩৫)।
এ ছাড়া ৪ থেকে ১২ জানুয়ারি কক্সবাজারে নিহত হয়েছেন আরো নয় মাদক ব্যবসায়ী, যার মধ্যে মাত্র একজন জেলা শহরের এবং বাকি আটজনই টেকনাফ এলাকার।
আত্মসমর্পণ নিয়ে বিতর্ক
টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের নামে ‘নাটক’ ও ‘বাণিজ্য’ চলছে—এমন অভিযোগ তুলে মানবাধিকার কর্মী লিটন বলেন, “মাদক ব্যবসায়ীদের ‘আত্মসমর্পণ’ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।”
“কারা আত্মসমর্পণ করছে, কীভাবে করছে, তাদের বিরুদ্ধে কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে, পুনর্বাসনের কী ব্যবস্থা হবে, তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে, সেগুলোর ভবিষ্যত কী হবে—এসব বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার।”
“আর এ ধরনের সুযোগ দিলে সবাইকেই তা দিতে হবে,” মত দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই সাবেক নির্বাহী। তিনি বলেন, পুলিশের কাছে কক্সবাজার জেলার এক হাজার ১৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম থাকলেও আত্মসমর্পণের সুযোগ পেয়েছে মাত্র ১০২ জন। এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে হবে।
র্যাব-১৫ এর টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. মির্জা শাহেদ মাহতাব বেনারকে বলেন, “আত্মসমর্পণকারীদের বাইরে এখনো অনেক শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়ে গেছে। ফলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসা কিছুটা কমলেও তা বন্ধ হয়নি।”