মাদক বিরোধী অভিযানে ক্রসফায়ারে নিহত ১৮৪

প্রাপ্তি রহমান
2018.07.20
ঢাকা
মাদক বিরোধী অভিযানে ক্রসফায়ারে নিহত ১৮৪ -1 পুলিশের হাতে আটক সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী, হাজারীবাগ, ঢাকা, মে ১৭, ২০১৮
নিউজরুম ফটো

দুই মাস ধরে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে প্রায় ২০০ লোক নিহত হয়েছেন। উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার জানিয়েছেন, তারা 'ক্রসফায়ারে' নিহত হয়েছেন।

পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান মাদক বিরোধী অভিযানের সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ''ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা অপ্রত্যাশিত''। পাশাপাশি তিনি এও বলেন, গ্রেপ্তার এবং মাদক উদ্ধারের সংখ্যার তুলনায় ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ কম।

মনিরুজ্জামান বেনারকে আরও বলেন ,“মে মাসের মাঝামাঝি থেকে পুলিশ ২৫ হাজার ৫৭৫টি মামলায় গ্রেপ্তার করেছে ৩৭ হাজার ২২৫ জনকে। অন্যদিকে আজকে (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ১৮৪। কাজেই আমরা মাদক ব্যবসায় অভিযুক্তদের আইনের দ্বারস্থ হতে দিচ্ছি না এমনটা বলা যাবে না।”

তবে মানবাধিকার কর্মীরা ক্রসফায়ারের বিষয়টি বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। তারা এসব ঘটনার নিবীড়, স্বচ্ছ এবং স্বাধীন তদন্ত দাবী করেছেন।

অন্যদিকে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন,‘'মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই ঘটে থাকে। আমরা প্রায়ই দেখি, দুই দল মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। তাতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।”

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন,  দুঃখজনক হলেও সত্য- ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ এখন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার  ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছে এবং খুব দ্রুত এই অবস্থা থেকে উত্তরণ পাওয়া সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। দেশে ৭০ লাখ মানুষ এখন মাদকাসক্ত। বাংলাদেশ এখন মাদকের বড় বাজার। যারা এই অবৈধ ব্যবসাটা করছেন তারা রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও আশীর্বাদ ও সমর্থন পাচ্ছেন। আমরা তাদের কারাগারে আটকে রাখতে পারছি না।”

পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্রগুলো নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছে, যাদের মাদক সম্রাট বলা হয়, তাদের অধীনস্ত কেউ গ্রেপ্তার হলে তারাই ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্নক যুদ্ধ

মধ্য মে -তে এই অভিযান শুরু হবার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক ভাষণে মাদক সমস্যাকে সন্ত্রাস সমস্যার সাথে তুলনা করেন এবং ঘোষণা দেন, মাদকের বিরুদ্ধে তার সরকার জিরো টলারেন্স দেখাবে।

প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, ''যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করা হয়েছে, একইভাবে মাদকের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করা হবে।''

গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনার নিউজকে বলেছিলেন , “আমাদের চলমান অভিযান হলো ‘মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ।  নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।''

এই মাদকবিরোধী অভিযান মূলত ইয়াবা পাচার বন্ধে করা হচ্ছে। ইয়াবা এক ধরণের নেশাজাতীয় ট্যাবলেট যেটা মিয়ানমার থেকে অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশে আসে। মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পরিচালক সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদের মতে, প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ ইয়াবায় আসক্ত, এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাদক সমস্যা।

তদন্তের দাবী

মাত্র দু’মাসে এত মানুষের মৃত্যুতে দেশ – বিদেশের মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।  বিশেষ করে-ক্রসফায়ারে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলন একরামুল হকের মৃত্যু ব্যাপক আলোচনার জন্ম নেয়।

একরামুল হক, পুলিশ কর্তৃক অভিযুক্ত টেকনাফের একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদ মে মাসের ২৮ তারিখে রাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হোন। এরপর নিহতের স্ত্রী একটি সংবাদ সন্মেলন করেন, যেখানে তিনি একটি অডিও ক্লিপ সাংবাদিকদের শোনান এবং দাবী করেন- একরামুলের নিহত হবার ব্যাপারটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

এই অভিযান ব্যাপকভাবে দেশি এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন,  ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মারাত্মক হুমকি। যারা নিহত হচ্ছেন, তাঁরা আসলে বিচার পেলেন না।

“ক্রসফায়ার কোনো সমাধান হতে পারে না। আমার আর একটা প্রশ্ন আছে। মাদক ব্যবসায়ীরা এত অস্ত্র কোত্থেকে পাচ্ছেন যে তাঁরা রোজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করছেন? তার মানে কি এতদিন ধরে মাদক বিক্রেতারা যে অস্ত্র যোগাড় করেছেন সে বিষয়টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখেও দেখেননি? এখন যদি আমরা এই বিষয়ের তদন্ত চাই, সেটা কি অযৌক্তিক হবে?” ফয়জুল কবির বেনারকে বলেন।

গত জুনের শুরুতে, নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশকে সকল বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু ও স্বাধীন তদন্তের দাবী জানান।

এই সংস্থার এশিয়া প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ব্র্যাড এডামস বলেন, প্রত্যেকের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

তিনি আরও বলেন '' যদিও বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের জিরো টলারেন্সের কথা বলে আসছেন, তবু আমরা এই ধরণের হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে দেখছি, সেটা মাদক ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন।''

জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

গত মাসে এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হেদার নুয়ার্ট বলেন, “আমরা বাংলাদেশের প্রতি সবগুলো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত অভিযোগের স্বচ্ছ ও নিবীড় তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি'।  তিনি আরও বলেন,  “বাংলাদেশের অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের আচরণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, যার মধ্যে রয়েছে সকল সন্দেহভাজনের নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হবার সম্ভাবনা এবং আইনের আশ্রয় পাবার অধিকার।”

“আমরা মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ প্রতিফলন দেখতে চাই,” বলেন নুয়ার্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় “চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে কোনো ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি” বলে বেনারের কাছে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি বলেন, “মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যই প্রশিক্ষিত।”

তিনি আরও বলেন, '' আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর আক্রমণ হলে আত্মরক্ষার অধিকার অবশ্যই তাদের রয়েছে। ''

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।