এক রাতে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত পাঁচ

প্রাপ্তি রহমান
2018.09.18
ঢাকা
180918_Crossfire_1000.jpg ঢাকায় র‍্যাবের মাদক বিরোধী অভিযানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে গাঁজাসহ আটক কয়েকজন। ২৯ আগস্ট ২০১৮।
AFP

বাংলাদেশের তিনটি জেলায় একরাতে র‍্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানী ঢাকায় দুজন, কক্সবাজারের উখিয়ায় দুজন ও পাবনায় একজন নিহত হয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, নিহতদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত এবং বন্দুকযুদ্ধেই মৃত্যু হয়েছে তাঁদের।

র‍্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করছে বলে দাবি করে আসছে দেশি বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। যদিও বরাবরের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করে এই বন্দুকযুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে এসব বাহিনী।

“বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো মানুষকে হত্যা করা একটা রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক। কারণ এতে একজনকে শুধুমাত্র অভিযুক্ত করে, অভিযুক্তকে বিচারের সুযোগ না দিয়ে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়,” বেনারকে বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।

“বিচার বহির্ভূত মানুষ হত্যার ঘটনাগুলো আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, আমরা শঙ্কিত হই। ভীত হই এবং ভয়মুক্ত হয়ে জীবন যাপন করবার যে মূল নাগরিক অধিকার সেটি এর মাধ্যমে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে,” বলেন তিনি।

নিহতরা ডাকাত ও মাদক ব্যবসায়ী

ঢাকায় র‍্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুজনের নাম পরিচয় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। র‍্যাব-২ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল আনোয়ারউজ্জামান অবশ্য দাবি করেছেন নিহতরা সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য। রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পেছনে বসে তারা ডাকাতির পরিকল্পনা করছিল।

“আমাদের সঙ্গে তাদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটি ঘটে ডাকাতির প্রস্তুতির সময়, গুরুতর আহত অবস্থায় আমরা তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা তাদের মৃত ঘোষণা করেছেন,” বেনারকে বলেন আনোয়ারুজ্জামান।

ঘটনাস্থল থেকে তিনটি পিস্তল, গুলি ও দেশীয় অস্ত্র এবং ডাকাতির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক বাচ্চু মিয়া দুটি মৃতদেহ মর্গে থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, নিহতদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর কোঠায়।

কক্সবাজারের উখিয়ায় র‍্যাব-৭ এর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন আব্দুস সামাদ (২৭) এবং মো. আবু হানিফ (৩০)। আবদুস সামাদের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এবং মো. আবু হানিফের বাড়ি যশোরের অভয়নগরে। সোমবার দিবাগত রাতে শহীদ এটিএম জাফর আলম আরাকান সড়কের মরিচ্যা বাজার এলাকায় গোলাগুলিতে দুজন নিহত হন বলে জানিয়েছে র‍্যাব-৭ এর কক্সবাজার ক্যাম্প।

ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. মেহেদী হাসান ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের দাবি করেছেন।

“আবদুস সামাদ ও মো. আবু হানিফ দুজনই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। নিহতরা টেকনাফের দিক থেকে আসা একটি ট্রাকে করে যাচ্ছিলেন। মরিচ্যাবাজার চেকপোস্টে তাদের থামার সংকেত দেওয়া হয়েছিল। অমান্য করে তারা চলে যায় ও পরে র‍্যাব সদস্যদের গুলি ছোড়ে,” মো. মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন।

ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে র‍্যাব ১ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা, একটি বিদেশি পিস্তল, একটি দেশে তৈরি বন্দুক, আট রাউন্ড গুলি পাওয়ার দাবি করেছে।

পাবনার আটঘরিয়ায় নিহত কুরবান আলী (৩০) ‘চরমপন্থী নেতা’ এবং হত্যা ও ডাকাতির আসামি বলে অভিহিত করেছে পুলিশ। আতাকুইল্যা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, কুরবান আলী চরমপন্থী দলের সদস্য। আটঘরিয়া ও আতাকুইল্যা থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা ও ডাকাতির মামলা আছে।

“সোমবার রাতে সন্ত্রাসীরা আটঘরিয়ার কৈজুরী গ্রামের শ্মশানের পাশে বৈঠকে বসেছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। সে সময় সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। আত্মরক্ষার জন্য গুলি ছুড়লে একজন ঘটনাস্থলে পড়ে যায়,” মাসুদ রানা সাংবাদিকদের বলেন।

“পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন,” বলেন তিনি।

ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি রিভলবার, চার রাউন্ড গুলি, ২০টি ইয়াবা এবং একটি মোটরসাইকেল উদ্ধারের দাবি জানিয়েছে।

সাড়ে তিন মাসে ২২৮ জন হত্যা

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সর্বশেষ মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ মে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ‘নির্বিচারে’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। র‍্যাব-পুলিশের দাবি নিহতদের সবাই মাদক ব্যবসায়ী।

এক হিসেবে সংস্থাটি বলছে ১৫ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই সাড়ে তিন মাসে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ২২৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে বন্দুকযুদ্ধে ২৪ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে।

“কিন্তু কিছু কিছু নিহতের স্বজনেরা বলেছেন, নিহত ব্যক্তি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন, তথাকথিত জঙ্গি দমন ও মাদকবিরোধী অভিযানসহ বিভিন্ন অজুহাতে কোনো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত মূল অপরাধীকে আড়াল করতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে,” বেনারকে জানান অধিকারের সম্পাদক নাসিরউদ্দীন এলান।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।