গ্রেপ্তার আরসা প্রধানের নামে রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ
2025.03.21
ঢাকা

যে সংগঠনের আক্রমণের কারণে আট বছর আগে রাখাইন থেকে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সামরিক অভিযানের মুখে বাংলাদেশে চলে আসে, আরসা নামে পরিচিত সেই সংগঠনের প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি (৪৮) এখন বাংলাদেশ পুলিশের হেফাজতে।
শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন সহিংসতা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে ২০২১ সালে এক রোহিঙ্গা নেতা ও ২০২২ সালে বাংলাদেশের ডিজিএফআই’র এক কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জুনুনির গ্রেপ্তারে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার খুশি হবে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।
গত ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। সেখানে তিনি প্রায় চার মাস অবস্থান করছিলেন। তাঁর আরও নয় সহযোগীকে ময়মনসিংহ থেকে আটক করা হয়। ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে আতাউল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার তথ্য জানিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহীনুর আলম শুক্রবার বেনারকে বলেন, আতাউল্লাহ ভালো আছেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদ তেমন কিছু বলেননি।
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, আতাউল্লাহ আটকের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। সে কারণে তিনিও মিয়ানমার সরকারকে এ ব্যাপারে কিছু জানাননি।
রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমি যতটুকু জানি মিয়ানমার সরকার আরসাকে পছন্দ করে না।”
আতাউল্লাহ আটকের দিনই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটস আরসা এবং আরএসওসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা শরণার্থী শিবিরে যুদ্ধাপরাধ করছে বলে জানায়। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আতাউল্লাহসহ অন্য অপরাধীদের বিচারের আহ্বান জানায়।
প্রত্যাবাসনের পথ খুলবে?
আতাউল্লাহর আটক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, আতাউল্লাহ আটকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সমর্থন পেতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও মানবিক সহায়তার জন্য বাংলাদেশের উচিত আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা করা।
তিনি বলেন, এই প্রেক্ষাপটে আরাকান আর্মি চাইবে বাংলাদেশ যেন তাদের বিরোধী গ্রুপ তথা আরসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আতাউল্লাহ জুনুনির আটক সেদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
“এর মাধ্যমে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়ই বুঝবে যে আরসা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা বড়ো হুমকি নয়,” বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।

কে এই আতাউল্লাহ?
রোহিঙ্গা নেতা ও সংশ্লিষ্টরা জানান, আতাউল্লাহর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইনে বুছিডং এলাকায়। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার আরাকান (বর্তমান রাখাইন) রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন শুরু করলে তাঁর পরিবার ভারত হয়ে পাকিস্তানের করাচি চলে যায়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজে) জানায়, ১৯৭৭ সালে করাচির একটি শরণার্থী শিবিরে জন্ম আতাউল্লাহর। সত্তর ও আশির দশকে সৌদি সরকার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মাধ্যমে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে সেদেশে আশ্রয় দেয়। লেখাপড়া ও কাজের সুযোগের জন্য পরিবার আতাউল্লাহকে করাচি থেকে সৌদি আরব পাঠায়। সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি মসজিদে কাজ করতেন তিনি।
সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সভায় নিয়মিত অংশ নেয়া আতাউল্লাহ সুবক্তা হিসেবে সেখানকার শেখদের নজরে পড়েন। সেখানকার রোহিঙ্গারাও তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জানায়।
আতাউল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরুদ্ধে অভিযোগ সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিরোধী এবং রোহিঙ্গাদের ৩৪টি শিবিরে হত্যা, গুম, মানবপাচার, রাহাজানি, হুমকি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ সকল ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত।
আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে—একটি ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে হত্যার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনে এবং অপরটি ২০২২ সালে বাংলাদেশের ডিজিএফআই কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগে।
আইসিজে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে আরসার নেতৃত্বে আসেন আতাউল্লাহ। তিনি নেতৃত্বে আসার অনেক আগে গ্রুপটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর একযোগে হামলা চালানোর পর আরসা এবং আতাউল্লাহ আবার আলোচনায় আসে।
ওই হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মম সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই হামলায় অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত এবং বহু মানুষ আহত ও ধর্ষিত হন। সেখানকার উগ্র বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালায়।
মিয়ানমার সরকার আরসাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়।
২০১৭ সালের পর মাঝে মধ্যে ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন আতাউল্লাহ। দুই দেশে অপরাধী হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
আইসিজে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের সরকারি বাহিনী এবং প্রতিপক্ষ আরএসও দ্বারা বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মংডু ও বুছিডং এলাকায় আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা চালানোর পরও আরসা মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাহিনীর সাথে মিলে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে।
জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষক ও লেখক এম আবুল কালাম আজাদ বেনারকে বলেন, “আতাউল্লাহর নেতৃত্বে আরসা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর একটি প্রকল্প যারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একযোগে আক্রমণের পর পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা।”
ওই আক্রমণের পর মিয়ানমার সেনাদের বিরুদ্ধে আরসা আর কোনো আক্রমণ করেনি জানিয়ে তিনি বলেন, “বরং তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কাজ করছে।”
“তারা মিয়ানমার সেনাদের সাথে হাত মিলিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এর ফলে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা বিরোধী হয়ে উঠেছে,” বলেন আবুল কালাম আজাদ।

রোহিঙ্গারা বিভক্ত
উখিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর সৈয়দ উল্লাহ বলেন, “আরসা প্রধানকে আটকের ঘটনায় ক্যাম্পে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ তাঁর মুক্তি চাইছেন, আবার অনেকে এই শীর্ষ অপরাধী আটক হওয়ায় খুশি। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, খুন ও অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ ছিল।”
আরসার হাতে গুমের শিকার ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ আমিন। প্রায় তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এলেও এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন নির্যাতনের চিহ্ন।
আমিন বেনারকে বলেন, “আতাউল্লাহ’র গ্রেপ্তারে আমরা খুশি হয়েছি। আশা করছি, তাঁকে বাংলাদেশ কঠোর শাস্তি দেবে।”
অন্যদিকে আরেক গ্রুপ আতাউল্লাহ’র মুক্তি চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভিডিও প্রচার করছে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ১২ নম্বর ক্যাম্পের একদল রোহিঙ্গা নারী বলেন, “আমরা আমাদের নেতা আবু আহমেদ জুনুনিকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করছি।”
প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে সহায়তা করেছেন আব্দুর রহমান।