গভীর মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে রোহিঙ্গারা: জাতিসংঘ মহাসচিব
2025.03.15
ঢাকা

খাদ্য সহায়তা আরো কমালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বসবাস করা রোহিঙ্গারা মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে-এমন আশঙ্কা করে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “এটি হবে নিঃসন্দেহে এক বিপর্যয়কর ঘটনা। রোহিঙ্গারা কষ্ট পাবে এবং বহু প্রাণহানি ঘটবে।”
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শনের পরদিন শনিবার (১৫ মার্চ) এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, “আমরা একটি গভীর মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে।”
“অর্থ সহায়তা কাটছাঁটের ফলে ২০২৪ সালে বরাদ্দ সহায়তার মাত্র ৪০ শতাংশ চলতি বছর পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ, যার শুরু হবে খাদ্য রেশনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে,” বলেন তিনি।
সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয় এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মহাসচিব বলেন, “বর্তমান সময় বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত একটি ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে তাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা।”
রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান এবং তাঁদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি, বাংলাদেশের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা জানি যে, সেখানে (মিয়ানমার) পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারজুড়ে সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে এবং সীমান্ত পেরিয়ে বাস্তুচ্যুতি ঘটছে।”
“আমি মিয়ানমারের সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতার উস্কানি রোধ করার আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন গুতেরেস।
জাতিসংঘ মহাসচিবের চার দিনের বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় দিনে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও অংশ নেন। শুরুতে তাঁরা দুজন লিখিত বক্তৃতা দেন। এরপর তাঁরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।

মানবিক করিডোর চায় জাতিসংঘ
রাখাইনে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে সহায়তা পাঠাতে একটি করিডোর প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে জাতিসংঘ আলোচনা করছে বলে জানান সংস্থাটির মহাসচিব।
গুতেরেস বলেন, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সফল করার জন্য আমাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে। পরিস্থিতি অনুকূল হলে বাংলাদেশ থেকেও এমন একটি মানবিক চ্যানেল থাকা উচিত যা স্পষ্টতই পুনর্বাসনকে সহজতর করবে। এই কারণেই মানবিক সহায়তার জন্য অনুমোদন এবং সহযোগিতা প্রয়োজন।”
এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “এই বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলাপ চলছে। এটি একটি অপারেশনাল বিষয় এবং আমরা এটি নিয়ে আলোচনা করব।”
এর আগে ফোর্টিফাই রাইটস একটি বিবৃতিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক নাগরিকদের কাছে মানবিক সহায়তা এবং আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সহজতর করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
জাতিসংঘের মতো বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে ফেরত যাওয়ার প্রত্যাশা করে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে, জাতিসংঘ এ বিষয়ে আমাদের সহায়তা দিয়ে যাবে।”
আরাকান আর্মির নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, “আমরা জানি—রাখাইনে নতুন শক্তির উদয় হয়েছে। আমরা সেই শক্তিসহ অন্যান্য শক্তির ওপর চাপ তৈরি করতে চাইছি—যাতে করে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে।”
রাখাইনে চলমান অস্থিতিশীল পরিবেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “বর্তমানে রাখাইনে মিয়ানমার আর্মির সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে। অবশ্যই এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অত্যন্ত কঠিন। একটি প্রয়োজনীয় সমাধান খুঁজে কের করা, সংঘর্ষ থামানো এবং সংলাপ পরিবেশ তৈরি করার জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও প্রতিবেশীর চাপ দেওয়া উচিত।”
সংলাপ ও ঐকমত্যে সহায়তায় প্রস্তুত জাতিসংঘ
“বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ পর্বে রয়েছে”—উল্লেখ করে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, “এই সন্ধিক্ষণে শান্তি, সংলাপ ও ঐকমত্যে সহায়তার জন্য প্রস্তুত জাতিসংঘ।”
তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর পরিসরে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধির ভবিষ্যতের জন্য জনগণের আশাকে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।”
“একটি ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে,” বলেন গুতেরেস।

বিএনপি ও এনসিপির সাথে বৈঠক
বাংলাদেশ সফরকালে জাতিসংঘ মহাসচিব শনিবার প্রধান রাজনৈতিক দলের সাথেও আলোচনায় অংশ নেন।
শনিবার দুপুরে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বলেছি, নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব বিষয় আছে, সেগুলো করে ফেলা, দ্রুত নির্বাচন করা এবং একটা পার্লামেন্টের মাধ্যমে বাকি বিষয়গুলো করতে হবে।”
এদিকে ঢাকার হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টালে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করে বেরিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “নির্বাচনকে আমরা একটি সংস্কারের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি, সংস্কারের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখি। কোনো রকম সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কাজে দেবে না। ”
গত ১৩ মার্চ বিকেলে চারদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতিসংঘ মহাসচিব উখিয়ায় শরণার্থীশিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেন।
সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব শনিবার ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।