ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ: বিক্ষোভের মুখে বন্ধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান

জেসমিন পাপড়ি
2022.01.07
ঢাকা
ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ: বিক্ষোভের মুখে বন্ধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ঢাকার সদরঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে চলমান একটি লঞ্চের সামনে দিয়ে খেয়া নৌকায় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন একজন মাঝি। ১৫ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

লঞ্চের অনিয়ম-ত্রুটি চিহ্নিত করতে শুরু করা ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম নৌশ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে বন্ধ করতে হয়েছে।

সম্প্রতি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনার পর বুধবার ওই অভিযান শুরু হয়। নানা অনিয়ম-ত্রুটি পাওয়ায় অন্তত ১১টি লঞ্চকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু নৌশ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে বৃহস্পতিবার থেকেই এ অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার বৈঠক হয়।

বৈঠকে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোর ত্রুটি দূর করতে প্রায় মাস খানেক সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বেনারকে জানান লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার সিনিয়র সহ সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল।

সদরঘাটে বিআইডব্লিউটিএর বন্দর কর্মকর্তার দপ্তরে রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বদিউজ্জামান বাদল বলেন, “সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লঞ্চে যেসব ত্রুটি আছে সেগুলো বিআইডব্লিউটিএ, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর এবং লঞ্চ মালিক সমিতি যৌথভাবে তদন্ত করে সেগুলো সংশোধন করবে।”

“চলতি (জানুয়ারি) মাসের মধ্যে এসব ত্রুটি সংশোধন করতে হবে। এই মাসে আর কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত চলবে না,” বলেন তিনি।

“কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, মালিক এবং কর্মচারী মিলে সকল ত্রুটি সংশোধন করে লঞ্চ পরিচালনা করা হবে। এ ছাড়া কোনো লঞ্চ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না,” বলেন বদিউজ্জামান বাদল।

ঠিক কবে থেকে আবার ভ্রাম্যমাণ আদালত চলবে, সেবিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারেননি বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অনেকগুলো কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ পাঁচটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। কমিটিগুলো নৌ নিরাপত্তার জন্য পর্যায়ক্রমে তদারকি কার্যক্রম জোরদার করবে।”

“বিশেষ করে ঢাকা নদী বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোর নিরাপত্তাজনিত বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। তবে এই কাজ এখনো শুরু করেনি। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে শুরু করতে পারব,” বলেন তিনি।

১১ টি লঞ্চকে জরিমানার বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, “নৌযানগুলোতে ত্রুটি ছিল। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি অন্যান্য তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা হবে।”

জানা যায়, বৃহস্পতিবার দীর্ঘ দুই ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ত্রুটি সারাতে সময় চাওয়ার পাশাপাশি শুধু কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটলেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা না করার অনুরোধ জানান মালিকেরা। এছাড়া মালিকদের পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানানো হয়, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলেই মালিকদের গ্রেপ্তার না করে তদন্ত কমিটির তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরে গ্রেপ্তার করা হয়।

সূত্র জানায়, বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিন লাগানোসহ বৈঠকে মালিকেরা ১০টি বিষয়ে আলোচনা করেন এবং এসব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে সকল পক্ষ মিলে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

ঢাকা থেকে বরগুনাগামী যাত্রীবাহী অভিযান-১০ লঞ্চটি গত ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছানোর পর অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়, এতে মারা গেছেন অন্তত ৪৮ জন। আহত হয়েছেন ৯০ জনের বেশি।

ওই ঘটনায় নৌ পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা পেয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। লঞ্চটিতে আগুনের সূত্রপাত ইঞ্জিন থেকে বলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদ্যমান লঞ্চগুলোর ত্রুটি ‘মাইনর’

বিদ্যমান লঞ্চগুলোতে ত্রুটি থাকলেও সেগুলো বড়ো ধরনের নয় বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “কোনো নৌযান নৌপথে চলার যোগ্য কিনা সেটা নির্ভর করে সার্ভে সার্টিফিকেট দ্বারা। এই সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো নৌযান বিআইডব্লিউটিএর রুট পার্মিট পেতে পারে না। সেটা নৌ পথে চলতেও পারে না।”

“যখন একটি নৌযানকে রেজিস্ট্রেশন এবং সার্ভে সার্টিফিকেট দেয়া হয় তখন সেগুলো ‘আপ টু দ্যা মার্ক’ই থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু কিছু ডেভিয়েশন (বিচ্যুতি) হয়। নিরাপত্তা সরঞ্জামগুলো হয়তো এদিক সেদিক হয়ে যায়,” বলেন তিনি।

“এই হিসেবে লঞ্চগুলোতে যেসব ত্রুটি আছে সেগুলো খুব মাইনর। এসব ত্রুটি তো এক-দু দিনেই সারানো যায়। যেমন: ইঞ্জিনরুমের পাশে রান্না ব্যবস্থা করা, যাত্রীদের হাতের নাগালে বয়া থাকার কথা থাকলেও তা একটু উপরে আছে ইত্যাদি।”

“ছোটখাটো ত্রুটিগুলোও আমলে নিয়ে লঞ্চগুলোকে জরিমানা করা হচ্ছে,” বলেন রফিকুল ইসলাম।

তবে নৌযানগুলো সুষ্ঠুভাবে তদারকি করতে জনবল সংকট রয়েছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে সুষ্ঠুভাবে তদারকি করা কষ্টসাধ্য। তাই জনবল বাড়াতে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। জনবলের অনুমোদন দিলে তদারকি ব্যবস্থা মেইনটেন করতে পারব।”

অবৈধ লঞ্চের হিসাব নেই

বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, সারাদেশে এখন বৈধ সার্ভিস সার্টিফিকেট নিয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ আছে ৭৮০টির মতো। তবে অবৈধ লঞ্চের কোনো হিসাব নেই। আর এজন্য এখন পর্যন্ত কোনো নৌযান শুমারি না হওয়াকে দায়ী করেন নৌযান মালিকরা।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার সিনিয়র সহ সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বেনারকে বলেন, “অবৈধ লঞ্চের কোনো হিসাব নেই। কারণ, এ পর্যন্ত কোনো লঞ্চ বা জাহাজ বা নৌ শুমারি হয়নি। আমরা সরকারকে বহু অনুরোধ করেছি।”

“নৌ পরিবহন অধিদপ্তর এবং বিআইডব্লিউটিএ- এই দুটো ডিপার্টমেন্ট এত বড়ো হওয়া স্বত্বেও কখনো কোনো নৌ শুমারি করেনি। এ ধরনের শুমারি করলে জানা যাবে কতগুলো জাহাজ বৈধ এবং কতগুলো অবৈধ,” বলেন তিনি।

“এমনকি মাস্টার এবং ড্রাইভারও অত্যন্ত কম। ফলে মাস্টার এবং ড্রাইভার ছাড়াই আমাদের লঞ্চ চালাতে হয়,” বলেন বদিউজ্জামান বাদল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।