সীতাকুণ্ড কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক রাখার অনুমতি ছিল না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
2022.06.08
ঢাকা
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি ছিল না বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ওই ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ৪৬ জন মারা গেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কন্টেইনার ডিপোটি তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি-রপ্তানি কাজে ব্যবহারের অনুমতি ছিল। তাঁর মতে, রাসায়নিক পদার্থ না রাখলে সেখানে দুর্ঘটনাটি হতো না।
“বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষকে শাস্তি পেতে হবে এবং তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারবেন না। পুলিশ ইতিমধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত মঙ্গলবার সীতাকুণ্ড থানায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। মামলার এজাহারের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে।
এতে অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানোসহ আসামিদের বিরুদ্ধে আহত করা, জীবন ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা হুমকিতে ফেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে।
মামলায় বিএম কন্টেইনার ডিপো লিমিটেডের আট কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাতদের আসামি করেছেন বাদী এসআই মো. আশরাফ ছিদ্দিক।
মামলার আট আসামীরা হলেন; (১) বিএম কন্টেইনার ডিপো কোম্পানি লিমিটেডের ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আক্তার, (২) প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক খালেদুর রহমান (৩) সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, (৪) সিনিয়র নির্বাহী মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, (৫) সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল আজিজ, (৬) সি অ্যান্ড এফ ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, (৭) সিএফএস নজরুল ইসলাম এবং (৮) মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান।
কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিপদজনক রাসায়নিক পদার্থ কন্টেইনারে রাখা, রাসায়নিক পদার্থ রাখার বিষয়টি অবহিত না করা, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষিত জনবল না রাখা। এসব কারণে বহু হতাহত হয়েছেন এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রপ্তানিমুখী ও আমদানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যসহ সাধারণ পণ্য ভর্তি কন্টেইনারের পাশাপাশি রাসায়নিক রাখা হতো। কিন্তু অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না। রাসায়নিক জাতীয় পদার্থের আগুন নেভানোর মতো কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।
এজাহারে বলা হয়, দমকল বাহিনীর একাধিক দল পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এই সময়ে বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেখানে রাসায়নিক পদার্থের ড্রাম ভর্তি কন্টেইনার থাকার বিষয়টি দমকল বাহিনীকে অবহিত করেনি। ফলে রাসায়নিক পদার্থের আগুন পানি দিয়ে নেভানো সম্ভব হয়নি।
এক পর্যায়ে ছয় থেকে সাতটি কন্টেইনার একসাথে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের কারণে আশেপাশের দুই থেকে তিন কিলোমিটার এলাকায় থাকা অনেকগুলো ভবনের কাচ টুকরা টুকরা হয়ে যায়।
ডিপোর বিস্ফোরিত কন্টেইনারের ছড়িয়ে পড়া টুকরার আঘাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে নিয়োজিত দমকল বাহিনীর কর্মী, পুলিশ সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ হতাহত হন বলে জানানো হয় এজাহারে।
ডিপো কর্তৃপক্ষের দাবি: রাসায়নিকের কথা জানানো হয়েছে
বিএম কন্টেইনার ডিপো লিমিটেডের মুখপাত্র মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বুধবার বেনারকে বলেন, “আগুন শুরুর পর আমাদের একজন কর্মী ৯৯৯ এ ফোন করে আগুনের ঘটনা অবহিত করেন এবং তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন যে, সেখানে রাসায়নিক পদার্থ মজুত করা ছিল।”
তিনি বলেন, “ডিপোতে মোট ৩৭টি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ছিল। এর মধ্যে ২৭ কন্টেইনার ভিয়েতনামে এবং ১০ কন্টেইনার পাকিস্তানে রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল।”
শামসুল হায়দার বলেন, “এই ৩৭ কন্টেইনার হাইড্রোজেন পারক্সাইড আমাদের কারখানায় প্রস্তুত করা হয় এবং সেগুলো রপ্তানির জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমাদের ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর একটি বিএম কন্টেইনার ডিপো কোম্পানি লিমিটেড। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস যৌথ বিনিয়োগে সীতাকুণ্ড থানার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর নামক স্থানে ডিপোটি অবস্থিত।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্য এবং চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে রপ্তানি পণ্যগুলো এই ডিপোতে রাখা হতো।
গত ৪ জুন রাত সাড়ে নয়টার দিকে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয় এবং প্রায় এক ঘণ্টা পর রাসায়নিক পদার্থ হাইড্রোজেন পারক্সাইড ভর্তি কন্টেইনারগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে।
প্রায় ৮৭ ঘণ্টা পর বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নিভেছে ভয়াবহ ওই আগুন।
সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল সাংবাদিকদের বলেন, “এখন আগুন নেই, ধোঁয়া আছে একটু একটু। গার্মেন্টস পণ্য থাকায় যখনই পানি দেওয়া হচ্ছে, তখনই ধোঁয়া বের হচ্ছে। তবে এখন কোথাও আগুন জ্বলছে না।”
ডিপোর আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬। বুধবার ভোরে আগুনে দগ্ধ একজন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
এছাড়া সর্বশেষ বুধবার ডিপো থেকে আরো দুই ব্যক্তির খণ্ডিত দেহাংশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সীতাকুণ্ড থাকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ।
এদিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত নিহত ৪৩ জনের মধ্যে ২৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করে ময়নাতদন্তের পর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিস্ফোরণে দুই শতাধিক আহতের মধ্যে ৮৯ জন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।