সংসদে প্রতিবেদন: জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মসূচির টাকা আত্মসাৎ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.07.06
ঢাকা
সংসদে প্রতিবেদন: জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মসূচির টাকা আত্মসাৎ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকার পুরানা পল্টনে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ ভবনে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়ের সামনে কয়েকজন দর্শনার্থী। ৬ জুলাই ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের ঘটনা চিহ্নিত করেছে রাষ্ট্রীয় হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়।

ইসলামের আলোকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী পাঁচ লাখ বই ছাপার জন‌্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।  কিন্তু সেসব বই না ছাপিয়েই পুরো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পেশ করা প্রতিবেদনে অভিযোগ করেছে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়।

এতে বলা হয়, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ‘জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম’ শীর্ষক কর্মসূচির পুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাই বাবদ অর্থ পরিশোধ দেখানো হলেও “প্রকৃতপক্ষে পুস্তক মুদ্রণ করারই প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”

নিরীক্ষাকালে সংশ্লিষ্ট ক‌্যাশ বই, স্টক রেজিস্ট্রার, বিল-ভাউচার ও নথিপত্র পর্যালোচনা করেও পুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কোনো প্রমাণ মেলেনি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে রাষ্ট্রের তিন কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

করণীয় বুঝতে পারছে না ধর্ম মন্ত্রণালয়

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, “সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম” নামে বইটির ৫ লাখ কপি মুদ্রণ ও বাঁধাই করে প্রত্যেক জেলা অফিসে প্রেরণের জন‌্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

অথচ বইগুলো জেলা অফিসে প্রেরণ বা বিতরণ এবং জেলা অফিস কর্তৃক গ্রহণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  স্টক রেজিস্ট্রারেও বইগুলোর কোনো এন্ট্রি ছিল না।

প্রতিবেদনটিতে এই ঘটনাকে “মারাত্মক আর্থিক অনিয়ম” হিসেবে অভিহিত করেছে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ‌্যান্ড অডিটর জেনারেল অফিস।  এর সুরাহা করতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে ৩০ দিনে মধ‌্যে জবাব চাওয়া হলেও তা  না পেয়ে প্রতিবেদনটি সংসদে পেশ করা হয়।

প্রতিবেদনে কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে ওই অর্থ আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক ইতোমধ্যে মারা যাওয়ায় করণীয় ঠিক করা যাচ্ছে না বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মুঃ আঃ হামিদ জমাদ্দার। ওই মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে আরো অনেক অডিট আপত্তি রয়েছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, “যে সময়ে এই অডিট আপত্তি দেয়া হয়েছে সেই সময়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যিনি মহাপরিচালক ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে।”

“তবে দুঃখজনক বিষয় হলো তিনি মারা গেছেন। সে কারণে আমরা বুঝতে পারছি না এ ব‌্যাপারে কী করা উচিত,” বলেন সচিব।

তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব, এই ঘটনায় আর কারও দায় আছে কিনা তা খতিয়ে দেখব।”

‘এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না’

বাংলাদেশে সরকারি বিভাগগুলোর আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। কোনো আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, মন্ত্রণালয়, বিভাগের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে।  সংশ্লিষ্ট বিভাগ সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে আর্থিক অনিয়মগুলো প্রতিবেদন আকারে রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করেন কম্পট্রোলার অ‌্যান্ড অডিটর জেনারেল।

রাষ্ট্রপতি প্রতিবেদনগুলো গ্রহণ করে সংসদ অধিবেশনে পেশ করার জন্য  সংসদ সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেন। সংসদ থেকে থেকে প্রতিবেদনগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারি হিসাব কমিটিতে পাঠানো হয়।

পরবর্তীতে অডিট আপত্তিগুলোর কারণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে থাকে সরকারি হিসাব কমিটি।

সরকারি হিসাব কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রধান হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের “নিরীক্ষা আপত্তিগুলো সরকারি হিসাব কমিটেতে এসেছে এবং সব প্রতিবেদন কমিটিতে আলোচনা হবে।”

তিনি আরও বলেন, “জঙ্গিবাদ একটি বড়ো সমস্যা।  এই সমস্যা শুধু পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে নির্মূল করা যাবে না—এমন কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।  সরকারও সেটি মনে করে।”

সে কারণেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পুস্তক-লিফলেট প্রকাশ-বিতরণ করতে বলা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

“এখন যদি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বরাদ্দকৃত অর্থ লোপাট করে, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না,” বলেন আব্দুস শহীদ।

“এই অর্থ যারা লোপাট করেছে তাদের জবাবদিহি করা হবে,” যোগ করেন তিনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদের মতে, “বাংলাদেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না।” তবে “এই দুর্নীতি অন্যান্য দুর্নীতির চেয়ে আলাদা।”

বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “এই দুর্নীতি এমন সময় করা হয়েছে যখন জঙ্গিদের কার্যক্রম প্রায় তুঙ্গে ছিল।  ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব ছিল জঙ্গিবাদের মতো দুর্যোগ সামাজিকভাবে মোকাবেলা করা। কিন্তু তারা জাতির প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।”

“এই অর্থের পরিমাণ কম হলেও বিষয়টি গুরুতর। যেটুকু ধরা পড়েছে, প্রকৃত চুরির অর্থ আরও অনেক বেশি হবে বলে ধরে নেওয়া যায়,” মনে করেন আব্দুর রশীদ।

তাঁর মতে, এই ঘটনার মাধ্যমে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সামাজিক সচেতনমূলক কর্মসূচি সম্পর্কেও “প্রশ্ন চলে আসে।”

“আমি আশা করি, এ অন্যায়ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ওই টাকা পুনরুদ্ধার করা হবে,” যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত তা চলতে থাকে। সে সময় হামলা চালায় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) ও জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)।

২০০৬ ও ২০০৭ সালে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং শায়ক আব্দুর রহমানসহ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি নেতাকে আটক করে ফাঁসি দেয়া ও কয়েকশ জঙ্গি গ্রেপ্তারের পর জঙ্গি হামলা থেমে যায়।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশে ফের একের পর এক জঙ্গি হামলা শুরু হয়। ওই সময় ইরাক-সিরিয়ায় আল কায়েদা ও নতুন জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর উত্থান বাংলাদেশের জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে রক্তাক্ত হামলা চালায় জঙ্গিরা।

ওই ঘটনার পর কঠোরভাবে  জঙ্গিবাদ দমনের পাশাপাশি এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচার চালানোর জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।