নির্বাসিত সাংবাদিক কনক সরওয়ারের বোন রাকার মুক্তি চেয়ে ১৫ সংগঠনের চিঠি

পুলক ঘটক
2022.01.28
ঢাকা
নির্বাসিত সাংবাদিক কনক সরওয়ারের বোন রাকার মুক্তি চেয়ে ১৫ সংগঠনের চিঠি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউটিউব পেজ পরিচালনা করেন সাংবাদিক কনক সরওয়ার। তাঁর বিরুদ্ধে “প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য” বোনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মনে করেন কনক। ২৮ জানুয়ারি ২০২২।
[ইউটিউব পেজের স্ক্রিনশট]

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক কনক সরওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাকে “প্রতিহিংসামূলক” দাবি করে মামলা দুটি প্রত্যাহার ও তাঁর দ্রুত মুক্তি দাবি করেছে দেশি-বিদেশি ১৫টি মানবাধিকার সংগঠন।

রাকার জামিনে মুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধকতা আরোপ না করার জন্য বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের কাছে পাঠানো চিঠিতে সংগঠনগুলো অনুরোধ জানিয়েছে।

তবে চিঠি এখনো পাননি দাবি করে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা। বেনারের প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমি জানি না। আমি এখনো চিঠি পাইনি; পেলে কথা বলব।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের “অপব্যবহার হয়েছে” মর্মে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের স্বীকারোক্তিকে স্বাগত জানিয়ে এই আইনটি সংশোধন অথবা বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ওই চিঠিতে।

সংগঠনগুলো বলেছে, “বাংলাদেশ সরকার যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে না পারে, তাহলে আইনটি বাতিলের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে চিঠির অনুলিপি আইন মন্ত্রী এবং আইন সচিবের কাছেও পাঠানো হয়েছে। আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে বিষয়টি জানার জন্য বেশ কয়েকবার ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

চিঠিতে স্বাক্ষরকারী অন্যতম সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, “কনক সরওয়ার তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করায় এর প্রতিশোধ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁর বোন রাকাকে টার্গেট করেছে।”

গত ৫ অক্টোবর রাতে রাজধানীর উত্তরার বাসায় অভিযান চালিয়ে রাকাকে আটক করে র্যাব। গ্রেপ্তার অভিযানের ব্যাখ্যায় র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, “সাম্প্রতিক সময়ে একটি চক্র দেশ ও বিদেশে অবস্থান করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিদেশে অবস্থানকারী চক্রের সদস্যরা দেশীয় এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এর ধারাবাহিকতায় নুসরাত শাহরিন রাকাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

পরে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মাদক আইনে মামলা করা হয়।

এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওই চিঠির বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ বেনারকে বলেন, “কনক সরওয়ারের কারণে তাঁর বোন রাকাকে হেনস্তা করার বিষয়টি আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু কনক সরওয়ার আমেরিকায় বসে বাংলাদেশকে নিয়ে যে ধরনের অশ্লীল ও কুৎসাপূর্ণ কথাবার্তা বলেন তাতে কোনোভাবেই এটাকে সাংবাদিকতা বলার সুযোগ নেই।”

“কনক সরওয়ারসহ কিছু পলাতক ব্যক্তির আপত্তিকর কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের কারণে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এসবের দায়দায়িত্ব নিলে প্রেসফ্রিডম নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এতে মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচারের সংরক্ষক হিসেবে ভূমিকা রাখছে,” বলেন বাংলাদেশে সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনের এই নেতা।

চিঠিতে স্বাক্ষরকারী মানবাধিকার সংগঠনগুলো হলো: ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস (আইএফজে), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আর্টিকেল ১৯, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, কোয়ালিশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ, পেন আমেরিকা, পেন বাংলাদেশ, অ্যাক্সেস নাউ, অ্যান্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক এবং ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট।

নুসরাত শাহরিন রাকা। ফাইল ছবি। [সৌজন্যে: কনক সরওয়ার]
নুসরাত শাহরিন রাকা। ফাইল ছবি। [সৌজন্যে: কনক সরওয়ার]

আশা করছি সুবিচার পাব: আইনজীবী

নিম্ন আদালতে জামিন নাকচ হওয়ার পর হাইকোর্টে রাকার জামিনের জন্য লড়ছেন বিশিষ্ট আইনজীবী জেড আই খান পান্না। বেনারকে তিনি বলেছেন, “রাকা একজন নারী, একজন মা। তার ঘরে তিনটি শিশু আছে, যার মধ্যে একজনের বয়স তিন বছর। এই অবস্থায় সম্পূর্ণ বিনা দোষে তাঁকে প্রায় চার মাস যাবত জেলে রাখা হয়েছে, যা অমানবিক।”

তিনি বলেন, “গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাকা জানতে পারেন তার নামে একটি ফেইক আইডি খোলা হয়েছে। ১ অক্টোবর তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় এ বিষয়ে একটি জিডি করেন। যে মানুষটি আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে জিডি করল, তার নামেই পরে মামলা করা হলো। মামলায় জিডির কথাও গোপন করা হয়েছে।”

“তাঁর নামে একটি মাদক মামলাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মামলায় বলেছে গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে নাকি ৫ গ্রাম আইস উদ্ধার হয়েছে। অথচ, অভিযানের পর র্যাব তাদের বিবৃতিতে অন্য কথা বলেছিল,” বলেন পান্না।

তিনি বলেন, “আমরা উচ্চ আদালতকে বিষয়গুলো জানিয়েছি। এরপর রাকাকে কেন জামিন দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে গত ২৫ জানুয়ারি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আমরা আশা করছি সুবিচার পাব।”

আর্টিকেল ১৯ এর দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ শাখার পরিচালক বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ফারুক ফয়সল বেনারকে বলেছেন, “সমালোচনা বন্ধ করার জন্য এখন তাদের আত্মীয়-স্বজনের ওপর খড়গ পড়ছে। এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর মারাত্মক আঘাত।

রাকার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ক্রসফায়ার নিয়ে প্রতিনিয়ত গল্প সাজানোর ফলে মানুষ বিশ্বাস হারিয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের জন্য যদি মিথ্যা মামলা সাজানো হয় তবে আস্থা আরও নষ্ট হবে।”

বোনের গ্রেপ্তার এবং মামলা বিষয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কনক সরওয়ার বেনারকে টেলিফোনে বলেছেন, “আমার বোন কোনোদিন কোনো রাজনীতি করেনি। একেবারে সাদামাটা সংসারী মানুষ তিনি। ২৪ বছর আগে তার বিয়ে হয়েছে; এরপর মাত্র কয়েকবার তাকে দেখেছি। আমার সঙ্গে তার যোগাযোগও নেই।”

“আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যদি তার উপর নির্যাতন চালানো হয়, এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে?” যোগ করেন কনক।

বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে

কনক সরওয়ার প্রবাসে থেকে রিপোর্ট করার কারণে তাঁকে ভয় দেখানো এবং হয়রানির জন্য রাকার উপর নিপীড়ন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।

চিঠিতে তারা বলেছে, “বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে গুম, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র্যাবের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা শুধু রাকার স্বাধীনতাই নয়, তার নিরাপত্তার নিয়েও উদ্বিগ্ন।”

তারা বলেছে, “মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের উপর তীব্র আক্রমণের মাঝেই রাকার উপর এই নিপীড়ন ইঙ্গিত দেয় যে কর্তৃপক্ষ সমালোচনামূলক রিপোর্টিং বন্ধ করার জন্য কঠোর উপায় অবলম্বন করবে, তা বাংলাদেশে হোক বা বিদেশে হোক।”

সংগঠনগুলো বলেছে, “বাংলাদেশ সরকারের সচেতন হওয়া উচিত যে প্রবাসী সাংবাদিক এবং সমালোচকদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপগুলো বিশ্ব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।