কোরান অবমাননা: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কিশোরী দীপ্তির জামিন
2022.02.17
ঢাকা

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় বন্দি কিশোরী দীপ্তি রানী দাস দীর্ঘ ১৬ মাস পর বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন।
হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই জামিন মঞ্জুর করে বলে বেনারকে জানিয়েছেন উচ্চ আদালতে দীপ্তিকে আইনি সহায়তা দেয়া মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নীনা গোস্বামী।
“আমরা এরই মধ্যে রায়ের সার্টিফাইড কপি চেয়ে আবেদন করেছি,” বলেন তিনি।
রায়ের অনুলিপি ডাকযোগে রাজশাহীর বায়া এলাকার মহিলা ও শিশু-কিশোরী নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রে (সেফহোম) পৌঁছানোর পর মুক্তি পাবেন দীপ্তি (১৮)। তিনি উত্তরবঙ্গের জেলা দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা ও পৌরশহরের ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য।
দীপ্তির ছাড়া পাবার পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সপ্তাখানেক লেগে যেতে পারে বলেও জানান নীনা গোস্বামী।
গত নভেম্বরে ১৮ বছরে পা দেওয়া উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী দীপ্তির জামিনের সংবাদে খুবই খুশি তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
“বেলা ১১টার দিকে খবরটা পেয়ে প্রথমেই ওর মাকে জানিয়েছি। প্রায় ১৬ মাস পর আজ আমরা একটু মন খুলে হাসতে পারছি,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন দীপ্তির বাবা দিলিপ কুমার দাস।
পরিবারের সবাই এখন দীপ্তির ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
নিম্ন আদালতে চার বার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যানের পর গত বছরের ১১ মে উচ্চ আদালত দীপ্তিকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছিল, কিন্তু জেলা প্রশাসকের (ডিসি) আবেদনের প্রেক্ষিতে সেই আদেশ স্থগিত করে দেয় আপিল বিভাগ।
পরবর্তীতে গত জানুয়ারির মাঝামাঝি আবার তাঁর জামিনের আবেদন করা হয় বলে বেনারকে জানান নীনা গোস্বামী।
পুলিশি তদন্তে দোষী দীপ্তি
পুলিশ বলছে, ফেসবুকে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ কোরআন অবমাননার পর দীপ্তি মেসেঞ্জারে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের গালাগালি করে আক্রমণাত্মক কথাবার্তাও বলেছিলেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় (১৭ বছর দুই মাস) তিনি এমনটা করেছেন বলে আদালতে জমা দেওয়া ‘দোষীপত্রে’ জানিয়েছেন তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, যার অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী পুলিশের চার্জটিশকে ‘অভিযোগপত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে প্রতিবেদনটিকে ‘দোষীপত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই দোষীপত্রে বলা হয়েছে, “দীপ্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজিটাল বিন্যাস হতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক) ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অভিপ্রায়ে কোরআন নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ছবি দ্বারা ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী কমেন্ট করেন।”
দীপ্তির ওই মন্তব্য এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে আক্রমণাত্মক কথাবার্তার ফলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করেন ওই তদন্ত কর্মকর্তা।
তাঁর দাবি, আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশু দীপ্তির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর দিনাজপুর পার্বতীপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মীর শহিদুল ইসলামের দায়ের করা এই মামলার তদন্ত শুরু করেছিলেন থানার আরেক এসআই মো. মিজানুর রহমান।
পরবর্তীতে স্থানীয় পুলিশ সুপারের আদেশে ওই বছরের ৪ নভেম্বর তদন্তভার নেন জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আশরাফুজ্জামান। গত ৯ ডিসেম্বর তিনি তদন্ত প্রতিবেদনটি দিনাজপুরের আদালতে পেশ করেন।
গত ২৫ নভেম্বরে এক বিবৃতিতে দীপ্তিকে মুক্তি দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি তাঁর মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জরুরি পদক্ষেপ চেয়েছিল।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
‘মীরাক্কেল’ খ্যাত ভারতীয় মুসলিম কৌতুক অভিনেতা মীর আফসার আলীর একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে ঘটনার সূত্রপাত। তাঁর ভেরিফায়েড পেইজের ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবরের ওই লেখায় হিন্দু ধর্মকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে অভিযোগ তুলে ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করেও বিভিন্ন মন্তব্য করা হয়েছে।
সেখানেই ২৭ অক্টোবর দীপ্তি কোরআনের ছবিসহ ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসআই আশরাফুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ঠিক ওই সময়ে ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিনে মহানবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রচারের জেরে সারাদেশেই মুসল্লিদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। যে কারণে দীপ্তির মন্তব্যটি নিয়ে পার্বতীপুরের দ্রুত খুব উত্তেজনা ছড়িয়ে যায়।”
ওই সময় ঘনিষ্ঠ বান্ধবীসহ অনেকেই মন্তব্যটি মুছে ফেলার জন্য অনুরোধ করায় দীপ্তি তাঁদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেছিল বলে জানান এই তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন,“পরে অবশ্য সে যখন দেখে বিষয়টি বেশি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, তখন নিজেই কমেন্টটি ডিলিট করে দেয়।”
মোবাইল নম্বর দীপ্তির নয়
দীপ্তির জব্দ করা মোবাইল ফোনটি ঢাকার ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষক অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) আইটি ফরেনসিক শাখার এসআই মো. রুকুনুজ্জামানের একটি মতামতও চার্জশিটে যুক্ত করা হয়েছে।
আলামতের স্ক্রিনশট সংযুক্ত পোস্টে দীপ্তির কমেন্ট পাননি তিনি। তবে দীপ্তির আইডি থেকে অন্য দুইটি আইডির সাথে বিতর্কিত স্ক্রিনশটটি আদান-প্রদানের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছেন ওই কর্মকর্তা।
তবে পুলিশের আইটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে দীপ্তির ফেসবুক একাউন্টের সাথে সংযুক্ত যে মোবাইল নম্বরটি পাওয়া গেছে, সেটিও দীপ্তির নয় বলে জানিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। পুলিশের জব্দ করা মোবাইল সেটে থাকা দুটি সিমের মধ্যেও নম্বরটি নেই।
“দীপ্তি মোবাইলটা একবার আছাড় দিয়েছিল। ‘ড্যামেজ’ (ক্ষতিগ্রস্ত) হওয়ায় সেটি ঠিকভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি,” উল্লেখ করে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “ওই নম্বরটি তাঁর না হলেও এটা বলার সুযোগ নেই যে সে দোষী নয়। কারণ সে নিজেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, আমার ভুল হয়েছে, আমি অনুতপ্ত।”
স্থানীয় মুসল্লিদের চাপে পার্বতীপুর মডেল থানায় বসে ফেসবুক লাইভে দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হওয়া দীপ্তির পরিবার শুরু থেকেই দাবি করে আসছে তাঁর ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হয়েছিল।
“তবে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে কিন্তু আইডি হ্যাক হওয়ার কথা উল্লেখ করেনি,” বলেন এসআই আশরাফুজ্জামান।
মামলা রংপুরে স্থানান্তর
দীপ্তির বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি বিচারের জন্য ইতিমধ্যে রংপুরের সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। ওই ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) রুহুল আমিন তালুকদার বেনারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তাঁর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো এই ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকায় এসেছিল মামলাটি। আগামী ১৩ মার্চ অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি হবে।
এই ট্রাইব্যুনালে দীপ্তির পরিবারকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
ব্লাস্ট রংপুরের প্রকল্প কর্মকর্তা ও আইনজীবী দিলরুবা রহমান আঁখি বেনারকে বলেন, “আমাদের জানামতে, মামলাটি শিশু আদালতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিনাজপুর থেকে এটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।”
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর প্রতিবেদনে দীপ্তিকে ‘সংঘাতে জড়িত শিশু’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন জানিয়ে দিলরুবা বলেন, “এখন কোন আদালতে মামলাটির বিচার হবে সেটি ট্রাইব্যুনালের বিচারকই ঠিক করবে।”