ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিত রেখে পর্যালোচনা চায় জাতিসংঘ

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.03.01
ঢাকা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিত রেখে পর্যালোচনা চায় জাতিসংঘ কারা হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর সমাবেশ। ১ মার্চ ২০২১।
[বেনারনিউজ]

কারা হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তৈরির কাজ স্বচ্ছতার সাথে দ্রুত শেষ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মিশেল ব্যাশলে। 

সোমবার এক বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যকারিতা স্থগিত করে এর বিভিন্ন ধারা পর্যালোচনার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ তিন দফা দাবিতে বিরোধী বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচির দিনেই ব্যাশলের এই বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। 

এর আগে রোববার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পুলিশের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় ১৩ নেতাকর্মীকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। 

রোববার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ছাত্রদলের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের তুমুল সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলি করে। এতে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হন। এই ঘটনায় পুলিশ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

রাজধানী ছাড়াও দেশের কয়েকটি স্থানে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো এই মৃত্যুর প্রতিবাদ বহাল রেখেছে, এসব কর্মসূচি থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি করা হচ্ছে। 

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের কোনো সুযোগ নেই। কারণ এই আইনটি মানুষকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই করা হয়েছে।

তবে সরকার এই আইনের অপব্যবহারগুলো পর্যালোচনা করবে বলে বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। 

মিশেল ব্যাশলে বলেন, “মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সরকারি তদন্তটি স্বাধীনভাবে, স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে এবং অন্যান্য বন্দিদের সাথে অন্যায় আচরণের বিষয়গুলোও এখনই তদন্ত করতে হবে।”

তিনি বলেন, “বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে আসছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু কিছু ধারা সরকারের সমালোচনাকারীদের শাস্তি দিতে বৃহৎ পরিসরে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।” 

ব্যাশলে বলেন, “বাংলাদেশের উচিত এখনই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির কার্যকারিতা স্থগিত করে এর বিভিন্ন ধারাগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এই কাজে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে আমার অফিস প্রস্তুত আছে।” 

এই বিবৃতির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সোমবার বেনারকে বলেন, “আমি জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমশিনারের বিবৃতি সম্পর্কে জানি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের কোনো সম্ভাবনা নেই।”

তিনি বলেন, “তবে আমরা এই আইনের অ্যাবিউজ (অপব্যবহার) নিয়ে পর্যালোচনা করব। তবে, আমি পরিষ্কার করে বলছি, আমরা আইনটি পর্যালোচনা করছি না; অ্যাবিউজগুলো পর্যালোচনা করছি।” 

মন্ত্রী বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার অফিসের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছি। বিভিন্ন দেশের বেস্ট প্র্যাকটিস (ভালো উদাহরণগুলো) নিয়ে আলোচনা করে দেখব।” 

বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর তদন্ত ও বিচার এবং আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে সোমবার চতুর্থ দিনের মতো প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল জোট। সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি হয়েছে। 

গত বছর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এই সংক্রমণ মোকাবিলার বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখে সেটি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন লেখক মুশতাক আহমেদ। এই অপরাধে গত বছর মে মাসে মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোরসহ ১১ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা দেশের করোনাভাইরাস সম্পর্কে অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছেন। তাঁদের জামিনের জন্য ছয়বার আবেদন করা হলেও তা বাতিল করে দেয় আদালত। 

আটকের দীর্ঘ নয় মাস পর ২০ জানুয়ারি পুলিশ ওই মামলার অভিযোগপত্র দেয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুশতাকসহ আসামিরা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য অথবা অপরাধমূলক তথ্যসহ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো তথ্য প্রচার করেছেন। 

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁদের সর্বশেষ আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে আহমেদ কিশোর অভিযোগ করেন, আটক অবস্থায় র‌্যাবের দুই কর্মকর্তা তাঁদের নির্যাতন করেছেন। 

পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন: আদালত

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের বিবৃতিতে জানানো হয়, আদালতে উপস্থাপনের সময় কিশোরের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে। 

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার মুশতাককে মৃত ঘোষণা করেন। 

তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মুশতাকের মৃত্যুকে ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিযোগ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে।

মিশেল ব্যাশলে মুশতাকের সাথে আটক কার্টুনিস্ট আহমেদ কবিরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। 

তবে সোমবার আহমেদ কবিরের জামিনের ব্যাপারে শুনানি শেষ করে বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের বেঞ্চ জানিয়েছে, আগামী বুধবার এ ব্যাপারে আদেশ দেবে।

বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করে আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “আমি কবিরের জামিনের ব্যাপারে হাইকোর্টে আবেদন করি। আদালত বলেছে আগামী বুধবার আদেশ দেবে।”

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “আদালত আজকে তার মন্তব্যে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নের জন্য পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের পুলিশ-র‌্যাব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে না। তারা পুরাতন আমলের পদ্ধতি নিয়েই মামলা তদন্ত করে। আর পুলিশের অজ্ঞতার খেসারত দিচ্ছে দেশের নিরীহ মানুষ; পুলিশ নয়।” 

এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “মুশতাক আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাঁকে দ্রুত কাশিমপুর কারাগার হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গাজীপুরে বড় হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর কারণ এখনও জানা যায়নি।” 

তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত না হলে বলা যাবে না, কীভাবে তিনি মারা গেছেন। খুব শিগগির আপনারা জানবেন।” 

মুশতাকের মৃত্যুর কারণ জানতে, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে।

আগামী চার কর্ম দিবস অর্থাৎ বুধবারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে কমিটিকে বলা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।