দশ মাস পর উচ্চ আদালতে জামিন পেলেন কার্টুনিস্ট কিশোর
2021.03.03
ঢাকা

ছয়বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে সপ্তমবারের চেষ্টায় অবশেষে জামিন পেলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। তাঁর সঙ্গে একই আইনে গ্রেপ্তার হয়ে গত সপ্তায় কারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন লেখক মুশতাক আহমেদ।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার তাঁকে স্বাস্থ্যগত কারণে ছয় মাসের জামিন দিয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন কিশোরের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
জামিন পেলেও গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ছাড়া পেতে তাঁর আরো কয়েকদিন লেগে যেতে পারে বলে বেনারকে জানান তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
কারা হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসাবে বুধবার ষষ্ঠ দিনের মতো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ।
সমাবেশ থেকে মুশতাকের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার, প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণকারী আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি করা হয়।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বুধবার বেনারকে বলেন, “মুশতাকের মৃত্যুর পর কিশোরের জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছিলাম। কারণ, তাঁর শরীর ভালো না। কান দিয়ে পুঁজ বের হচ্ছে। তাঁর উন্নত চিকিৎসা দরকার।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর ওপর নির্যাতন হওয়ার বিষয়টি আমরা আদালতে জানিয়েছিলাম। গত দুদিন শুনানি শেষে এই আদেশ হয়েছে। তাঁকে ছয় মাসের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছে আদালত।”
সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কিশোরের সাথে কারাগারে দেখা করেন তাঁর ভাই আহসান কবির।
তিনি বেনারকে বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী হাইকোর্টের আদেশ বিচারিক আদালতে যাবে, তারপর সেখান থেকে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে যাবে। কারা কর্তৃপক্ষ জামিনের আদেশটি কাশিমপুর কারাগারে পাঠাবে এবং তারপর তিনি মুক্ত হবেন।”
“আমরা ধারণা করছি, আগামী রোববার অথবা সোমবার তিনি মুক্তি পাবেন,” বলেন আহসান কবির।
এদিকে লেখক মুশতাক আহমেদের কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হবে বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “মত প্রকাশের স্বাধীনতা হলো আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কোনো আইন পাশ করে এই অধিকারকে খর্ব করা যায় না।”
তিনি বলেন, “এই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমরা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আজ (বুধবার) জাতীয় প্রেসক্লাবের মানববন্ধন করেছি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়েছি।”
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মত প্রকাশের জন্য নাগরিকদের সাজা প্রদান করে। তাই, অসাংবিধানিক এই আইন বাতিল করতে হবে,” বলেন বদিউল আলম।
কার্টুনিস্ট কিশোরের জামিন হওয়াকে “একটি সুসংবাদ” হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় করা মামলাটি প্রত্যাহার করতে হবে।”
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করায় পুলিশের পক্ষ থেকে গতবছর ৫ মে লেখক মুশতাক আহমেদ এবং কিশোরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।
পরের দিন ৬ মে র্যাবের হাতে আটক হন মুশতাক এবং কিশোর।
“আটকের পর থেকে নিম্ন আদালতে মোট ছয়বার জামিন আবেদন করা হলেও জামিন মেলেনি,” জানান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
আটকের দীর্ঘ নয় মাস পর ২০ জানুয়ারি পুলিশ ওই মামলার অভিযোগপত্র দেয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুশতাকসহ আসামিরা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য অথবা অপরাধমূলক তথ্যসহ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো তথ্য প্রচার করেছেন।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁদের সর্বশেষ আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে কিশোর অভিযোগ করেন, আটক অবস্থায় র্যাবের দুই কর্মকর্তা তাঁদের নির্যাতন করেছেন।
এর দুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন মুশতাক আহমেদ। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে গাজীপুরের তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হস্তান্তর করা হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
কারা হেফাজতে মুশতাকের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন স্বচ্ছতার সাথে শেষ করার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যকারিতা স্থগিত করে এর বিভিন্ন ধারা পর্যালোচনার জন্য এক বিবৃতিতে সরকারকে পরামর্শ দেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মিশেল ব্যাশলে।
এছাড়া ওই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলোসহ বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
কারাগারে মুশতাকের মৃত্যুকে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হত্যা’ হিসাবে অভিহিত করে এর প্রতিবাদে ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আন্দোলন শুরু করে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন।
এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিএনপিসহ ছাত্রদলের কমপক্ষে ৫০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
সর্বশেষ সোমবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, লেখক মুশতাকের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত এবং প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে বাম সংগঠনগুলো।
এদিকে কারাগারে মুশতাকের মৃত্যু “অনভিপ্রেত” বলে মন্তব্য করলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি নাকচ করে দিয়ে বুধবার এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ জানিয়েছেন “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশের মানুষের ডিজিটাল নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। কারো চরিত্র হনন করা হলে তাঁকে ডিজিটাল নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।”
এর আগে গত সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেছিলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে না। তবে আমরা এই আইনের অ্যাবিউজ (অপব্যবহার) নিয়ে পর্যালোচনা করব।”
ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন: গণতন্ত্র অবনতির চিত্র
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বরং তা অবনতির দিকে যাবার চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের জরিপে।
বুধবার প্রকাশিত “ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২১ ডেমোক্রেসি আন্ডার সিজ’ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে আসে।
প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার স্কোর নির্ণয় করে ফ্রিডম হাউস। এবছর মোট ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি অঞ্চলের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার চিত্র প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
প্রাপ্ত স্কোর অনুযায়ী দেশগুলোকে ‘মুক্ত’, ‘আংশিক মুক্ত’ এবং ‘মুক্ত নয়’ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। জরিপে চলতি বছর ৮২টি দেশ ও একটি অঞ্চল মুক্ত, ৫৯টি দেশ ও একটি অঞ্চল আংশিক মুক্ত এবং ৫৪টি দেশ ও ১০টি অঞ্চলকে মুক্ত নয় বলে চিহ্নিত করেছে ফ্রিডম হাউস।
প্রতিবেদন অনুযায়ী গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দিক থেকে বাংলাদেশ ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ। চলতি বছর মোট ১০০ পয়েন্টের মূল্যায়নের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩৯। গত বছরও বাংলাদেশর ছিল একই স্কোর।
ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে ২০১৯ সালে ৪১, ২০১৮ সালে ৪৫ এবং ২০১৭ সালে ৪৭ স্কোর করেছিল বাংলাদেশে।
প্রতিবেদন মতে, গত বছরের চেয়ে এ বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতার কোনো হেরফের না হলেও গত পাঁচ বছরে তা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে।
মূল্যায়নের মোট স্কোর পয়েন্ট ১০০। এর মধ্যে রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে ৪০, যার মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ১৫। নাগরিক স্বাধীনতার ৬০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ২৪। দুটো মিলিয়ে মোট স্কোর ৩৯।
বিরোধী রাজনৈতিক দল, সরকারের সমালোচনাকারী গণমাধ্যম ও নাগরিকদের অব্যাহতভাবে হয়রানি এবং তাঁদের কণ্ঠস্বর রোধ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে বাংলাদেশের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচনের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে ফ্রিডম হাউস।