ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গ এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নীতিমালায়
2022.03.09
ঢাকা

ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধে আঘাত করে এমন কিছু ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচার করা যাবে না—বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই ধারাটি নতুন দুটি পৃথক খসড়া নীতিমালায় সংযোজন করার প্রস্তাব এসেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই বিধান সংযোজন করা হলে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অপব্যবহার হতে পারে।
গত ফেব্রুয়ারিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রস্তুত করা হয়, “ওভার দ্যা টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা এবং বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নীতিমালা ২০২১ (খসড়া)।”
অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস-২০২১ এর খসড়া প্রস্তুত করেছে।
দুটি নীতিমালাতেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বুধবার বেনারকে বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশে আমরা এই প্রবিধানমালা প্রণয়ন করেছি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই প্রবিধানমালা প্রত্যাহার করার যে আহ্বান জানিয়েছে আদালতের হুকুম ছাড়া সেটি করা সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “এই প্রবিধানমালা নিয়ে বিটিআরসি’র একটি কমিটি কাজ করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর যদি কোনো সুনির্দিষ্ট মতামত ও সুপারিশ থাকে সেগুলো বিটিআরসি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি একই বিষয়ে দুটি পৃথক নীতিমালা কেন তৈরি করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তথ্য মন্ত্রণালয় নীতিমালা করছে। তবে আমি মনে করি ওটিটি নিয়ে নীতিমালা করার দায়িত্ব বিটিআরসি’র। ইন্টারনেট সম্পর্কিত বিষয় থাকলে সেই কাজ বিটিআরসি’র।”
সরকারের আহ্বানে, নীতিমালা দুটির ওপর মতামত দিয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
নীতিমালা ‘অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে’
মঙ্গলবার বিটিআরসি-কে পাঠানো এক চিঠিতে, সোশ্যাল মিডিয়া বিষয়ক খসড়া নীতিমালাটি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ৪৫ বিদেশি বেসরকারি সংগঠন। তাদের মতে, এই নীতিমালাটি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার খর্ব করে।
তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বেনারকে জানিয়েছেন, এই নীতিমালা প্রত্যাহার হবে না। আগামী মে মাসের মধ্যে নীতিমালাটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুত করা ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা
এবং বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নীতিমালা ২০২১ (খসড়া) এর ওপর এবং বিটিআরসি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস-২০২১ ওপর মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
ব্লাস্ট জানিয়েছে, দুটি নীতিমালাতেই বাক স্বাধীনতার উপর স্বেচ্ছাচারী বিধিনিষেধ আরোপকারী বিধান বিদ্যমান।
বেনারের হাতে আসা ব্লাস্টের মতামত অনুসারে, খসড়া নীতিমালার ১৩.৩ ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারার অনুরূপ যেখানে বলা হয়েছে, “কোনো ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক আকারে যে কোনো তথ্য প্রকাশ/সম্প্রচার, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করে” এমন কিছু প্রচার করা যাবে না।
ব্লাস্ট জানিয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে জনমনে অনেক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা রয়েছে। ফলে এই বিধানের অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকে যায়, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে।
উদাহরণ হিসাবে ব্লাস্ট জানিয়েছে, ঝুমন দাস, এবং ১৭ বছর বয়সী কলেজ ছাত্রী দীপ্তি রানী দাসকে “অনলাইন কন্টেন্ট শেয়ার করার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” করার অভিযোগে পৃথক ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন গ্রেপ্তার করা হয়।
ব্লাস্টের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যেমন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে এ খসড়া নীতিতে অন্তর্ভুক্ত এই সাদৃশ্যপূর্ণ বিধান আবারও অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বুধবার বেনারকে বলেন, “তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি একই বিষয়ে দুটি পৃথক নীতিমালা করছে এবং এই দুটি নীতিমালাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারার মতো ধারা সংযোজন করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি-দুই প্রতিষ্ঠানের নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে দেশে ও দেশের বাইরে মানুষের একটি যৌক্তিক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। আইনটিও মানুষের কাছে বিতর্কিত হয়ে গেছে। সেকারণে একই বিধান ওই দুই নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
নূর খান বলেন, “মানুষের মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে এ ধরনের নীতিমালা প্রস্তুত করার মূল উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচন। সরকার বর্তমানে এবং আগামী দিনগুলোতে এ-সংক্রান্ত যা কিছু করবে সেগুলোর একটি মাত্র উদ্দেশ্য: জাতীয় নির্বাচন।”
তিনি বলেন, “তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি‘র নীতিমালা দুটিই যেভাবে খসড়া করা হয়েছে সেগুলোর খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই নীতিমালা দুটি মানুষের বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসহ অন্যান্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করবে, মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মধ্যে ফেলবে।”
নূর খান বলেন, “সুতরাং, আমি আশা রাখি সরকার এই নীতিমালা দুটি বাদ দেবে অথবা এর মধ্য থেকে নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বাদ দেবে যাতে মানুষের মাঝে সংশয় না থাকে।”
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমুনিকেশন (বিএনএনআরসি) সম্পাদক এ.এইচ.এম বজলুর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, “বিটিআরসি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে জনগণের মতামত চাওয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ করার সুযোগ তৈরি করে হয়েছে। তবে এর মধ্যে ক্ষতিকর কিছু থাকলে সরকার জনস্বার্থে সেগুলো বাদ দিতে পারে।”
২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার মাস খানেক আগে দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল জগত নিয়ন্ত্রণ করতে বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পাশ করে বিএনপি সরকার। আইনটি পাশের সময় বিরোধিতা করে তখনকার বিরোধীদল আওয়ামী লীগ।
তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে এই আইন বাতিলের পরিবর্তে কিছু ধারার শাস্তি বৃদ্ধি করে। সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করে ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পাশ করে আওয়ামী লীগ সরকার।
আইনটির অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকার জাতিসংঘের সাথে কাজ করছে বলে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।