আটকের পর নির্যাতনের বিচার চেয়ে আদালতে কার্টুনিস্ট কিশোরের আবেদন
2021.03.10
ঢাকা

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দশ মাস জেল খেটে জামিনে মুক্ত হবার পাঁচদিন পরই আটক অবস্থায় তাঁর ওপর চালানো নির্যাতনের বিচার চেয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বুধবার দুপুরে তিনি এই আবেদন করেন জানিয়ে কিশোরের অন্যতম আইনজীবী রিপন বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে কিশোর আদালতের কাছে বিচার চেয়েছেন।”
বিচারক কে এম ইমরুল কিশোরের জবানবন্দি রেকর্ড করে তাঁর আবেদনের বিষয়ে পরবর্তীতে আদেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে জানান রিপন। তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুইদিন সময় লাগবে।”
রিপন জানান, আদালতকে কিশোর জানিয়েছেন, গত বছর ২ মে সন্ধ্যায় তাঁকে কাকরাইলের বাসা থেকে তুলে নেওয়ার পর থেকে ৫ মে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র্যাব) হেফাজতে দেওয়ার আগ পর্যন্ত অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।
গত ৪ মার্চ কারামুক্ত হওয়ার পর বেনারকে কিশোর জানিয়েছিলেন, নির্যাতনে তাঁর কানের পর্দা ফেটে গেছে। চোখ, দাঁত ও পায়ের ক্ষতি হয়েছে। পায়ের তালুতে পেটানোর কথাও বলেছিলেন কিশোর। এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর ভাই আহসান কবিরও এই প্রতিবেদককে একই তথ্য দিয়েছিলেন।
তবে গ্রেপ্তারের পর কিশোরের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি বলে তখন বেনারকে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
পুলিশের নথিপত্রে কিশোরকে ২০২০ সালের ৬ মে গ্রেপ্তারের কথা বলা হলেও এর চার দিন আগেই তাঁকে বাসা থেকে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয় বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন কিশোর।
তিনি বেনারকে জানান, “২ মে ২০২০ তুলে নেয়া হয়েছে। ৬ মে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।”
এই ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সেজন্য কিশোরের অভিযোগটির “বিশ্বাসযোগ্য একটি তদন্ত” এবং তদন্তে দোষীদের “অবশ্যই আইনের আওতায়” আনা উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন।
“এ ধরনের অভিযোগ প্রায় শোনা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো এর দায় এড়াতে পারে না,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু খুব সাধারণ ঘটনা। মানবাধিকার কর্মীরা বহুদিন ধরে এ জাতীয় নির্যাতন ও হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ করতে ২০১৩ সালে সংসদে পাশ করা হয় একটি আইন।
মানবাধিকার কর্মীদের হিসেবে, এ পর্যন্ত নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে অন্তত ১৯টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত রায় হয়েছে মাত্র একটি মামলার।
ঢাকার এক গাড়িচালককে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে থানায় নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে পল্লবী থানার তৎকালীন তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে গত সেপ্টেম্বরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত। অন্য দুই আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাজিরা দিলেন কিশোর
বুধবার সকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আবু বকর সিদ্দিকের আদালতেও হাজির হন কিশোর। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাবার পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম হাজিরা।
একই মামলার আরো দুই অভিযুক্ত দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া ও মিনহাজ মান্নানও এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
অধিকতর তদন্তের অংশ হিসেবে এই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে আবেদন করেছিল ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
এর মধ্যে দিদারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ায় আদালত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি না দিলেও মিনহাজকে একদিন জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. জাফর হোসেন।
আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে যে কোনো একদিন সিটিটিসি মিনহাজকে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “জামিনে থাকায় তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বরে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত মিনহাজকে এবং উচ্চ আদালত দিদারুলকে জামিন দিয়েছিল।
মুশতাকের মোবাইল-ল্যাপটপ
কিশোরের সাথে একই মামলায় অভিযুক্ত কারাগারে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের জব্দ করা মোবাইল ও কম্পিউটার ফেরত দেওয়ার আবেদন করার কথাও বেনারকে জানিয়েছেন আইনজীবী রিপন।
“এগুলো ফেরত দেওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত,” বলেন তিনি।
গত বছরের ৫ মে র্যাব কিশোর, মুশতাক, দিদারুল, মিনহাজসহ ১১ জনের নামে রমনা থানায় ওই মামলাটি করেছিল। এতে অজ্ঞাত আরো পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়।
এর মধ্যে কিশোর, দিদারুল ও মুশতাককে অভিযুক্ত করে গত ১৩ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করে রমনা থানা পুলিশ। তারা জানায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিলক মিনহাজ মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বাকি সাত আসামি তাসনীম খলিল, সাহেদ আলম, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, জুলকারনাইন সায়ের খান, আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার বিদেশে থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি বলেও উল্লেখ করা হয়।
পরবর্তীতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি মামলাটি অধিকতর তদন্তে সিটিটিসিকে নির্দেশ দেয় আদালত। এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবার তারিখ ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সিটিটিসি প্রতিবেদন না দেয়ায় আদালত ১০ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার দিন ধার্য করে।
এ বিষয়ে শুনানির আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি অবস্থায় মুশতাকের মৃত্যু হয়। নিম্ন আদালতে ছয়বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর গত ৩ মার্চ কিশোরের জামিন আবেদন মঞ্জুর করে উচ্চ আদালত। পরদিন ৪ মার্চ তিনি কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান।
কী ছিল সেই মামলার অভিযোগে
মামলার এজাহারে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, অভিযুক্তরা ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’ (ইংরেজিতে লেখা) নামের একটি ফেসবুক পেইজসহ তাঁদের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজবসহ রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিপ্রায়ে অপপ্রচার চালিয়েছেন।
তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে।
তবে মুশতাকের মৃত্যুর পর কিশোরের ভাই আহসান কবির বেনারকে বলেছিলেন, “আমার ভাই কিশোর কখনো কোনো রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল না, এখনও নেই।”