সাইবার ট্রাইবুনাল: মাত্র চার ভাগের এক ভাগ মামলায় সাজা, ভোগান্তি সবার
2021.03.16
ঢাকা

প্রতিষ্ঠার পর গত আট বছরে সাইবার ট্রাইবুনালে পাঠানো প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলার মাত্র ১২৮টির বিচার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আসামিদের সাজা হয়েছে ৩০টিতে, বাকি মামলাগুলো থেকে অভিযুক্তরা খালাস পেলেও বিনা বিচারে জেল খাটতে হয়েছে বহুদিন।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিষ্পন্ন হওয়া মামলার মাত্র চার ভাগের একভাগ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে, বাকিগুলো থেকে ছাড়া পেয়েছেন অভিযুক্তরা।
তবে শেষ পর্যন্ত সাজা না হলেও ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় অভিযুক্তরা বিনা বিচারে মাসের পর মাস জেল খেটেছেন। অভিযোগগুলো জামিন অযোগ্য হওয়ায় এই ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন মেলেনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
“ট্রাইবুনালে মামলার সাজা হওয়ার হার কম,” স্বীকার করে এই ট্রাইবুনালের সরকারি কৌসুঁলি নজরুল ইসলাম শামীম বেনারকে বলেন, “সাজা কম হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সাক্ষীরা সাক্ষী দিতে আসে না।”
তিনি বলেন, “মামলা চলাকালে সাক্ষীরা আসে না। যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান বাদী ও বিবাদীরা আপোষ করে ফেলেছে। আর সাক্ষী না দিলে তো সাজা হবে না।”
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় ২৬ জন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ৪০০ ব্যক্তি কারাগারে আছেন।
মানুষকে ‘হয়রানি’ করতে ব্যবহার হচ্ছে আইন
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন দুটি মানুষকে ‘হয়রানি’ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘অপব্যবহারের কারণে’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের জন্য এর আগে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
আইনটি বাতিল হবে না জানিয়ে গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে জানান, এই আইন ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্যই। তবে এই আইনের আওতায় যদি কোনো অপব্যবহার হয়ে থাকে সেগুলো সরকার পর্যালোচনা করবে বলে তিনি জানান।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং এর আগে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার “ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে” বলে বেনারকে জানান ঢাকা বারের সদস্য ও সিনিয়র আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস।
“পুলিশ ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষমতাসীন দলের নিচু স্তরের কোনো নেতা ডিজিটাল নিরাপত্তা অথবা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত আটক হন,” জানিয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু এই আইনে আনিত অভিযোগ অজামিনযোগ্য সেহেতু তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।”
প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, “আমরা মামলা পরিচালনা করার সময় দেখি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সেগুলোর মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব নয়; দায়সারা গোছের তদন্ত।”
তিনি বলেন, “দেখা যায়, সাইবার অপরাধের সাথে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অভিযোগের জন্যও ডিজিটাল নিরাপত্তা অথবা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে। পরে আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন অভিযুক্তরা।”
উদাহরণ হিসাবে প্রকাশ বলেন, ২০১৬ সালে বই মেলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগে ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটি বিক্রির দায়ে বদ্বীপ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ও ওই সংকলন গ্রন্থের সম্পাদক শামসুজ্জোহা মানিকসহ (৭৭) সংশ্লিষ্ট আরো দুইজনের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়।
তাঁদের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানো হয়। কয়েক মাস পরে তাঁরা স্বাস্থ্যগত কারণে জামিনে মুক্ত হন। গত বছর ২৩ জানুয়ারি সাইবার আদালতের রায়ে তাঁদের সবাই খালাস পেয়ে যান।
বদ্বীপ প্রকাশনীর মামলা সম্পর্কে কৌসুঁলি শামীম বলেন, “এই মামলাটি সাইবার ট্রাইবুনালে আসার কোনো যুক্তি ছিল না। কারণ এখানে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ছিল না। এটি একটি বই সম্পর্কিত। মামলা দণ্ডবিধির আওতায় করা দরকার ছিল।”
সরকারের সাইবার পুলিশ ইউনিট সেন্টার পরিচালনা করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এই সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার বেনারকে বলেন, “সাইবার আদালতে সাজার হার কম—এটি সত্য। এর অনেক কারণ আছে। সাইবার অপরাধ অন্যান্য অপরাধের মতো নয় বিধায় এই মামলাগুলোর তদন্ত প্রক্রিয়াও ভিন্ন।”
মামলার অপরাধ প্রমাণ করতে হলে “আদালতে আলামত এবং সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে হবে”, মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দেখা যায়, ডিজিটাল অথবা সাইবার অপরাধের আলামত এবং সাক্ষ্য প্রমাণ সঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন করা হয় না অথবা করা যায় না, তখন আসামিরা খালাস পেয়ে যান।”
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “ফেসবুকে যদি কেউ কটূ মন্তব্য লেখার পর মুছে দেয় তবে সেটিকে বের করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। সেই পদ্ধতি রক্ষা না করলে আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না। শুধু কিছু ব্যক্তি যদি বলেন যে তারা এই পোস্ট দেখেছেন তবে তার ভিত্তিতে আদালত সাজা দেবে না। আদালতের দরকার অকাট্য প্রমাণ।”
তিনি বলেন, “কোনো মানুষকে চাকু দিয়ে হত্যা করা হলে সেই চাকু উদ্ধার করে সেটি পরীক্ষা করে অপরাধ প্রমাণ করা যায়। কিন্তু সাইবার অথবা ডিজিটাল মামলার ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি আলাদা।”
“আমাদের পুলিশের তদন্তের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। জেলা পর্যায়ে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আছেন তাঁদের অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় দায়ের করা মামলা সঠিকভাবে তদন্ত করার মতো দক্ষতা অর্জন করেননি,” বলেন মাহমুদুল ইসলাম।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ফলে ভোগান্তি
সম্প্রতি কারা হেফাজতে নিহত লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করায় গত বছর মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হন। ছয়বার তাঁদের জামিন আবেদন বাতিল হয়।
মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর স্বাস্থ্যগত কারণে হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হন কার্টুনিস্ট কিশোর।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সংবাদের লিঙ্ক শেয়ার করার পর গত বছর ১০ মার্চ নিখোঁজ হন ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ৫৩ দিন পরে ৩ মে তাঁকে খুঁজে পায় পুলিশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একাধিক মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
গত বছর ২৫ ডিসেম্বর জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন কাজল। তবে, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলমান।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে সাইবার ট্রাইবুনালের মামলাগুলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের হতো। এই আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা ব্যাপকভাবে অপব্যবহৃত হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ‘মিথ্যা ও গুজব রটানোর’ দায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় আটক হন ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলম। কয়েক মাস জেল খাটার পর হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। সেই মামলা এখনও চলমান।
সমালোচনার মুখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাদ দিয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনের দুই মাস আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করে সরকার।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানহানি অথবা কটূ মন্তব্য অথবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণসহ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য ২০১৩ সালে দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইবুনাল স্থাপন করে সরকার।
আদালতের রেকর্ড অনুসারে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত এই ট্রাইবুনালে তিন হাজার ৩২৪টি মামলা সাইবার ট্রাইবুনালে পাঠানো হয়েছে। ২০১৯ সালে এক বছরে সর্বোচ্চ ৭২১টি মামলা বিচারের ট্রাইবুনালে এসেছে।