ঘূর্ণিঝড়ের পর বন্যা, ক্ষতিগ্রস্ত সিলেটের সাড়ে ছয় লাখ মানুষ
2024.05.31
ঢাকা

প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে গত সপ্তায় উপকূলীয় ১৯টি জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর এবার দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর সিলেট জেলায় দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা।
এতে ১৫টি উপজেলা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ।
উজানের পাহাড়ি ঢলে সুরমা, কুশিয়ারা, পিয়াইন ও সারি নদীর পানি বেড়ে যাওয়াই এই বন্যার কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে কয়েক দিনের টানা বর্ষণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জসহ মোট আটটি উপজেলার বন্যার্তদের জন্য প্রায় ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক রাসেল হাসান বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
“ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য থেকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী হয়ে পানি সিলেটে প্রবেশ করছে, পানি বাড়ছে। আমরা প্রস্তুত আছি,” বলেন তিনি।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বেনারকে বলেন, ছাতক উপজেলায় পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে।
পানিবন্দি কয়েক হাজার
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নের বাসিন্দা সালেহ আহমেদ শুক্রবার বেনারকে জানান, “গত পাঁচ দিন আগে থেকে সিলেটে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে বন্যা শুরু হয়। বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলার চার-পাঁচটি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
“অধিকাংশ মানুষের বাড়িতে পানি ঢুকেছে। খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ কাটা পড়েছে,” জানান সালেহ আহমেদ।
অনেকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি এবং কেউ কেউ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সুরমা-কুশিয়ারা নদী সংলগ্ন বেড়িবাঁধ সঠিকভাবে নির্মাণ করা হলে বন্যায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতো না।”
এখন পর্যন্ত সিলেটের চারটি উপজেলায় কমপক্ষে ১৭ থেকে ১৮ কিলোমিটার এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ।
“আকস্মিক বন্যার কারণ উজানে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যে কয়েক দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। সেখানকার পানি সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদী দিয়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে নেমে আসে।”
মেঘালয়ে যদি আগামী কয়েক দিন আর বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলে “সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে সিলেটের বন্যার পানি নেমে যাবে,” বলেও জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান বলেন, “সিলেটে বন্যার জন্য সাইক্লোন রিমালের ভূমিকা রয়েছে। রিমাল ঘন ঘন পথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব অঞ্চল দিয়ে ভারতের আসামের দিকে চলে যায়। ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সেখান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আকস্মিক বন্যা হচ্ছে।”
সমস্যার অন্যতম কারণ: হাওরে রাস্তা
গত কয়েক বছর ধরে আকস্মিক বন্যায় হাওর এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে বেনারকে জানান বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম। এর কারণ হিসেবে হাওর এলাকায় অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণকে দায়ী করেন তিনি।
তিনি বলেন “হাওরে বিশাল রাস্তা বানালে তো সমস্যা হবেই। হাওরে তো রাস্তা থাকার কথা নয়। এই রাস্তায় পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্রিজ, কালভার্ট এবং পানি পারাপারের যথেষ্ট নির্গমন পথ নেই। সেকারণে পানি মানুষের ঘরবাড়ি, লোকালয়ে ঢুকে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।”
প্রসঙ্গত, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদে তাঁর এলাকা হাওর বেষ্টিত মিঠামইন ও অষ্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হাওরের বুকে বানানো হয় দৃষ্টিনন্দন সড়ক।
এই সড়ক হাওর অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ২০২১ সালে নভেম্বরে হাওর অঞ্চলে রাস্তার পরিবর্তে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্প পাস করেছে সরকার।
হাওর জেলার সংসদ সদস্য ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ. মান্নান গত বছরের জানুয়ারিতে জানান, হাওরে আর কোনো রাস্তা নির্মাণ করা হবে না।
তিনি বলেন, অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ হাওর অঞ্চলের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।