সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৮ লাখ মানুষ
2024.06.20
ঢাকা

এক মাসের কম সময়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দ্বিতীয় দফা বন্যায় ১৮ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামে ভারি বর্ষণের কারণে কোরবানি ঈদের আগের দিন থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারি বর্ষণ।
মৌসুমি বায়ুর কারণে আগামী পাঁচ দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে অঞ্চলভেদে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে বলে বৃহস্পতিবার পূর্বাভাস জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উজানে ভারতের মেঘালয় এবং আসামেও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বলছেন, আরও বৃষ্টি হলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটবে।
বন্যায় সিলেটে ১০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। তিনি বলেন, জেলার প্রায় সব উপজেলা এখন বন্যা কবলিত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা। সেখানে সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ মহাসড়ক বাদে প্রায় পুরো এলাকায় বন্যার পানি ঢুকেছে।
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, গত মাসের বন্যায় সুনামগঞ্জে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এবার জেলার ১১টি উপজেলার এক হাজার ৩০৬টি গ্রাম বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ।
স্থানীয় জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট শহরের নদী-সংলগ্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সুরমাসহ বিভিন্ন নদীর পানি উপচে শহর প্লাবিত হয়েছে এবং বৃষ্টির জমে থাকা পানি নদী দিয়ে নামতে পারছে না।
মহাসড়ক ও বিভিন্ন উঁচু স্থানে গবাদি-পশুসহ আশ্রয় নিয়েছেন বন্যাকবলিত মানুষেরা।
এই পরিস্থিতিতে সিলেট বিভাগের এইচএসসি এবং আলিম পরীক্ষা ৮ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক বলেন, বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে অধিকাংশ মানুষ সেখানে আসতে চাচ্ছেন না। মানুষ নিরুপায় না হলে বসতবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন না। তারপরও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে।
সুনামগঞ্জে বন্যাকবলিতদের জন্য প্রায় ৭০০ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর জন্যও আলাদা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান রাশেদ ইকবাল চৌধুরী।
‘একমাত্র যানবাহন এখন নৌকা’
সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ সদরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন সুমন বলেন, “আমাদের এলাকার ধলাই নদী উপচে পাঁচটি ছাড়া ১৩০টি গ্রামের সবকটিতে পানি ঢুকে পড়েছে। ঈদের দিন কোম্পানিগঞ্জে ঈদের নামাজ হয়নি। আমরা কেউ কোরবানি করতে পারিনি। কিছুসংখ্যক মানুষ পাকা বাড়ির ছাদে কোরবানি করেছে।”
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা শাহীন আহমেদ দুদু বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে মহাসড়কে আশ্রয় নিয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। অনেকের ফোনে চার্জ নেই। মানুষের সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। একমাত্র যানবাহন এখন নৌকা।”
শাহীন আরও বলেন, “আমাদের এলাকার শত শত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গবাদি পশু রাখার মতো জায়গা নেই।”
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলার অমলসিদ, শেওলা ও শেরপুর-সিলেট পয়েন্টে কুশিয়ারা নদী, কানাইঘাট ও সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ ও দিরাই পয়েন্টে সুরমা নদী, মৌলভীবাজারে মনু, মারকুলি পয়েন্টে মেঘনা-সুরমা নদী বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সাইফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “সিলেট অঞ্চলে যে বন্যা চলছে সেটিকে বলা যায় প্রথম দফার বন্যার সম্প্রসারণ। প্রথমবার বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ভারতের মেঘালয় এবং অন্যান্য উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে বৃষ্টি আধিক্যের কারণেই ফের পাহাড়ি ঢলে বন্যা শুরু হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সিলেট অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে আলাদা। সেখানে পাহাড়, হাওড় ও জলাভূমি রয়েছে। প্রতিবছর মে থেকে শুরু করে বর্ষার মৌসুমে উজান থেকে পানি নেমে বন্যা হয়।”
“তবে এবারের বন্যা একটু আলাদা। পুরো মে মাসে কোনো বৃষ্টি হয়নি। কৃষকরা বোরো ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন। জুনে বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে। বিভিন্ন সময় ধরে বৃষ্টি হলে এমন সমস্যা হতো না,” যোগ করেন তিনি।
সাইফুল আরও বলেন, “এই বন্যায় ফসলের ক্ষতি না হলেও সেখানকার হাজার হাজার মাছের খামার ভেসে গেছে, বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।সব মিলিয়ে অবস্থা ভালো নয়।”
সিলেটসহ সারাদেশে পাঁচ দিন বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ায় বর্তমানে দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সিলেট-সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের মেঘালয়-আসামে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভাটিতে পানি বাড়বে এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।”
এর আগে গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে প্রবল সাইক্লোন রেমালের আঘাতে ১৯ উপকূলীয় জেলায় বিশাল ক্ষয়ক্ষতির পরপর দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর সিলেট জেলায় বন্যা দেখা দেয়।
সাইক্লোনের প্রভাবে কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে সিলেট জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত সুরমা, কুশিয়ারা, পিয়াইন ও সারি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হাওড় পরিপূর্ণ হয়ে জনবসতিতে পানি ঢুকে আকস্মিক বন্যা (ফ্ল্যাশফ্লাড) সৃষ্টি হয়েছিল।
জেলার কয়েকটি উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় প্লাবিত হয়ে তখন লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
সিলেটের জেলা প্রশাসন জেলার কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জসহ মোট আট উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য প্রায় পাঁচশ আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছিল।