হাইসিকিউরিটি কারাগারে থেকে জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ
2019.12.27
ঢাকা

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ—বাংলাদেশ (হুজি-বি) কে কারাগারের ভেতর থেকে সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে হুজি-বির ছয় সদস্য গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করা হয়।
কারাগারে আটক জঙ্গিরা সেখান থেকেই দল গোছানোর চেষ্টা করছেন - আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অব্যাহতভাবে অভিযোগ জানিয়ে আসছে। এর মধ্যেই গতকাল গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে থেকে জঙ্গি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠল। বরাবরের মতোই কারা কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
“ যে দলটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের নেতা মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। এই রতন ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আটক রয়েছে। তার নির্দেশনায় মূলত এই গ্রুপটি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল, তাদের পরিকল্পনা রয়েছে সংগঠনকে নতুন করে সংগঠিত করে বিভিন্ন জায়গায় হামলার চেষ্টা করা,” জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন।
মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বাড্ডা থেকে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, সংগঠন পরিচালনা ও সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও ডাকাতিকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাদের নেতা মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন আছেন কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. বিল্লাল হোসেন (২৫), নুর আলম (২৮), মোঃ রফিকুল ইসলাম (২৯), আবুল মিয়া (৩৫), আব্দুর রহমান (৩০) ও আক্তার হোসেন (৩৪) । তাঁদের কাছ থেকে ১০০ মিলি চেতনানাশক পদার্থ, ১টি চাপাতি, ৩টি চাকু, ২টি মুখোশ ও একটি খেলনা পিস্তল উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা জিনিস ডাকাতির কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
হুজি-বি বাংলাদেশের প্রাচীনতম জঙ্গি সংগঠন। ১৯৯২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমাবেশে বোমা হামলা করে শতাধিক মানুষকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল সংগঠনটি। মুফতি আবদুল হান্নান দলটির সবশেষ নেতা। উচ্চ আদালতের রায়ে ২০১৭ সালে তাঁর ফাঁসির দন্ড কার্যকর করা হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায়।
কারাগার থেকে জঙ্গিদের বাইরে যোগাযোগ
হুজি-বির যে ছয় সদস্যের দলটি বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার হয়, তাদের নেতৃত্বে থাকা মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। প্রশ্ন উঠছে, হাইসিকিউরিটি কারাগারে থেকে কি করে বাইরে যোগাযোগ রাখছেন উজ্জ্বল।
সিটিটিসির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা কারাগারে জঙ্গি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির অভিযোগ করে আসছেন। হুজি-বিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কারা অন্তরীণ নেতাদের দলের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে বলে দাবি সিটিটিসির। তাঁরা হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে খুদে বার্তায় হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান। কারাগারে বসেই ১৫ আগস্ট হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী হামলার ঘটনায় আটক আকরাম হোসেন খান নিলয় ও আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এমন তথ্যও তাঁরা পাচ্ছেন।
এই বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির।
“মৃত্যুদণ্ড আসামি আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ মুঠোফোনে খুদেবার্তা দিয়ে আমাকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তিনি আমাকে একা তাঁর কাছে যেতে বলেন। ঘটনাটি ঘটে বিচারপ্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে,হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন। এ প্রসঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এ নিয়ে তদন্ত চলছে।
তা ছাড়া হোলি বেকারিতে জঙ্গি হামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি কারাগার থেকে পেয়েছেন বলেও এর আগে দাবি করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলম।
পুলিশের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কারা অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক টিপু সুলতান। তিনি বলেন, হাইসিকিউরিটি কারাগারে থাকে বাইরে যোগাযোগের সুযোগ নেই।
“সিটিটিসি প্রধান হুজি-বির যে জঙ্গির কথা বলছেন, সে জঙ্গিকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। তবে হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে বাইরে যোগাযোগের সুযোগ নেই,” টিপু সুলতান বেনারনিউজকে বলেন। তিনি আরও বলেন, হাই সিকিউরিটি কারাগারে জঙ্গিরা পৃথক সেলে থাকেন। প্রতিটি কক্ষ সিসি ক্যামেরার আওতার মধ্যে। ফলে জঙ্গিদের কারাগারের ভেতরে সাংগঠনিক কাজ করার সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, হাইসিকিউরিটি কারাগারে দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের রাখা হয়।
জঙ্গি ব্যবস্থাপনা জোরদার হওয়া প্রয়োজন
জঙ্গি ব্যবস্থাপনা নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৭ সালে হুজি-বির সবশেষ আমির মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সে সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন শহীদুল হক।
“মুফতি হান্নান কারাগারে বসে দলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। তাঁর সেল থেকে মুঠোফোন, মেমোরি কার্ড উদ্ধার হয়। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জেএমবির তৎকালীন আমির সালাউদ্দীন সালেহীনকে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়,” শহীদুল হক বলেন। তিনি আরও বলেন, কারাগারে ডির্যাডিকালাইজেশনের কোনো কর্মসূচিও নেই।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এ ধরনের যোগাযোগ অসম্ভব কিছু নয়।
“ দেখুন, সব জায়গায় সুশাসনের যে ঘাটতি কারাগার তার বাইরে নয়। কারাব্যবস্থাপনা যেভাবে করার কথা, সেভাবে হলে এত প্রশ্ন উঠত না,” সাখাওয়াত হোসেন বলেন।
তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগেই একজন কারা কর্মকর্তার বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর দেখেছি আমরা, এই সম্পদ সরকারি আয়ে তিনি গড়েননি, তাঁকে অসৎ পথেই এই বিপুল সম্পদ অর্জন করতে হয়েছে। অর্থ উপার্জনের জন্য কারারক্ষীরা যদি এ ধরনের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে থাকেন সেটা বিস্মিত হওয়ার মতো ঘটনা নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।