একুশ বছর পালিয়ে থাকার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.04.15
ঢাকা
একুশ বছর পালিয়ে থাকার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি গ্রেপ্তার দুই দশক আগে রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শফিকুর রহমানকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ১৪ এপ্রিল ২০২২।
[সৌজন্যে: র‌্যাব]

একুশ বছর আগে ঢাকার রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান ওরফে শফিকুল ইসলাম ওরফে আব্দুল করিমকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল হামলার পর থেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে ইমামের ছদ্মবেশে নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় শফিকুর ২১ বছর জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন বলে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান র‌্যাবের মিডিয়া ও আইন বিষয়ক পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তাঁকে বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরববাজার এলাকা থেকে আটক করা হয়।

গত শতাব্দীর আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এই জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের সহযোগী ছিলেন এবং হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি-বি) বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও।

রমনা বটমূলে হামলা মামলা ছাড়াও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি শফিকুর। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ.এম.এস. কিবরিয়া হত্যা মামলারও চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি।

আটকের পর শফিকুরকে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে বেনারকে জানান র‌্যাব-২ এর ক্যাপ্টেন নাঈম।

কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ রেজওয়ান দীপু শুক্রবার রাতে বেনারকে বলেন, তাঁরা শফিকুর রহমানকে আদালতে উপস্থাপন করলে সেখান থেকে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এখন আদালত শফিকুরের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে জানিয়ে ঢাকা বারের সদস্য প্রকাশ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, এরপরও তিনি আপিল করার সুযোগ পাবেন।

চোখ ফাঁকি দিয়ে একুশ বছর

শফিকুর পরিচয় গোপন করে আব্দুল করিম নামে নরসিংদীর একটি চরে অবস্থিত এক মসজিদে ইমামতির চাকরি নেন বলে জানান কমান্ডার মঈন।

“ইমামতির আড়ালে সে মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা দিত। অত্যন্ত কৌশলে মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করত। গত ২১ বছর এভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে আত্মগোপনে ছিল সে,” জানান মঈন।

তিনি জানান, রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যায় শফিকুর সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি গোপনে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, ২০০৮ থেকে নরসিংদীর একটি মাদ্রাসায় অবস্থান করতে থাকেন।

শফিকুরের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন জানান, শফিকুর স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ১৯৭৫ সালে মাদ্রাসায় ভর্তি হন, ১৯৮৩ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়তে যান। সেখান থেকে দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে ১৯৮৬ সালে দেশে ফেরেন। তারপর ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির ইউসুফ যিন নূরী মাদ্রাসা থেকে তিন বছরের ফতোয়া বিষয়ক কোর্স শেষ করেন।

করাচিতে থাকার সময় ১৯৮৭ সালে মুফতি হান্নানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পাকিস্তান থেকেই ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান গিয়ে তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন।

শফিকুর ১৯৯০ সালে গঠিত হরকাতুল জিহাদ-বাংলাদেশ নামক জঙ্গি সংগঠনের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরে এই সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী-বাংলাদেশ (হুজি-বি) নামে পরিচিতি পায়।

শফিকুর ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত হুজি-বি’র প্রচার সম্পাদক, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আমির এবং ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির শূরা সদস্য ছিলেন বলে জানান কমান্ডার মঈন।

লাদেনের বয়ানে রমনা বটমূলে হামলা!

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পুস্তক লেখা নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে যত জঙ্গি সংগঠন রয়েছে হুজি-বি তাদের সকলের প্যারেন্ট বলা যায়। তাদের দিয়েই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কাঠামোগত যাত্রা শুরু বলা যায়।

তিনি বলেন, আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে ফিরে এসেছে তারাই মূলত এই হুজি-বি প্রতিষ্ঠা করে। মুফতি হান্নানসহ আরও কয়েকজন ছিল এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রথম সারিতে।

“বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমের ভিত্তি ছিল ওসামা বিন লাদেনের একটি বয়ান.” জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহার হওয়ার পর ওসামা বিন লাদেন বিদেশী যোদ্ধাদের বলেছিল, তারা যেন নিজ নিজ দেশে গিয়ে ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতি এবং বিদেশি শক্তি ও মতবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।”

তিনি বলেন, “সেই আদর্শেই বলা যায় হুজি-বি বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালে যশোরে উদীচী সম্মেলনে হামলা চালায়, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। কারণ তারা মনে করে মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখ পালন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।”

১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় হুজি-বি। ওই হামলায় কমপক্ষে ১০ ব্যক্তি প্রাণ হারান।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষের দিকে ২০০১ সালে রমনা বটমূলে আক্রমণের পর মুফতি মোহাম্মদ হান্নানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নৃশংস বোমা হামলা চালায় হুজি-বি। হামলায় সুজন নামে এক হুজি-বি জঙ্গিসহ মোট ১০ ব্যক্তি প্রাণ হারান।

রমনা বটমূল হামলার আগে ২০০০ সালের ২১ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের হেলিপ্যাডে ৭৬ কেজি বোমা পুতে রাখে হুজি-বি। তবে সেই বোমা বিস্ফোরণের আগেই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দল ওই বোমা চিহ্নিত করে। প্রাণে বেঁচে যান তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর হুজি-বি’র তৎপরতা আরও বেড়ে যায়।

২০০৩ সালের ২১ মে সিলেট শাহজালালের মাজার জিয়ারত করার সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বি। ওই হামলায় আনোয়ার চৌধুরী মারাত্মকভাবে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। তবে প্রাণ হারান দুই ব্যক্তি।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বি। ওই হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ প্রাণ হারান ২৪ ব্যক্তি।

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বৈদ্যেরবাজারে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করা হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ.এম.এস কিবরিয়াসহ আরও চারজনকে। এই হামলাও হুজি-বি পরিচালনা করেছে বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার বিচারে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

“এতদিন পর হলেও হুজি-বি’র এই জঙ্গি ধরা পড়েছে এটি ভালো খবর। কিন্তু এই জঙ্গিসহ পলাতক জঙ্গিদের যদি আগে ধরা যেত তাহলে অনেক বড়ো বড়ো হামলা থেকে দেশ রক্ষা পেত,” বেনারকে বলেন আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।