বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.11.08
ঢাকা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিক্যাব আয়োজিত অনুষ্ঠানে কথা বলছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস (বামে)। ৮ নভেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মঙ্গলবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গিউয়েন লুইস।

মঙ্গলবার কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ডিক্যাব আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি জানান, রাজনৈতিক প্রতিবাদ কর্মসূচি ও সভা গণতন্ত্রের অংশ এবং এই কর্মসূচিকে সম্মান করতে হবে।

মূলত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে গত মাস থেকে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশ ও আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘ডিসেম্বরে খেলা হবে’ বলে বক্তব্য পরপরই সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কায় জাতিসংঘ কর্মকর্তা এই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় বিরোধী পক্ষের সঙ্গে পুলিশ বা সরকারি দল বা এর অঙ্গসংগঠনের বিক্ষিপ্ত মারামারি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেবে

এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সোমবার বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছি এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের সরকার গঠন করতে পারবে।”

তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেবে।

নেড প্রাইস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত আলোচনায় এই বিষয়টি তুলে ধরে।

তিনি বলেন, “এটি করতে আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা, আইনের শাসন সমুন্নত রাখা এবং মানবাধিকার ও সকল বাংলাদেশিদের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলে আসছি।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও উদ্বেগ জানানো এবং কোনো ধরনের দমন-পীড়ন ও বাধা ছাড়াই বিরোধী দলগুলোর প্রচারণা চালানোর নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাই।”

এর আগে রোববার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে দেখা করে সফররত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রসচিব আফরিন আখতার জানান, বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সুশীল সমাজসহ অন্যান্য অংশীজনের সাথে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র।

যা বললেন আবাসিক প্রতিনিধি

জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিক্যাব টক নামে ওই অনুষ্ঠানে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রধান দুই দলের মুখোমুখি অবস্থান এবং জননিরাপত্তা ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যাপারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির মন্তব্য জানতে চান সাংবাদিকরা।

জবাবে গিউয়েন লুইস বলেন, “গত মাসগুলোতে মানুষ আহত হয়েছেন, প্রাণও হারিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা উদ্বিগ্ন (কনসার্নড)।”

তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে জনগণকে রক্ষা করতে প্রত্যেকটি দল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং অন্যান্য অংশীজনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ।

চাপ সৃষ্টিতে এমন মন্তব্য

তবে সরকার জাতিসংঘের এই কর্মকর্তার উদ্বেগ বিবেচনায় নিচ্ছে না বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন।

তিনি মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন নিয়ে বিদেশিরা যেসব কথা বলেন, সেগুলো আসলে আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়। আমাদের দলীয় ও সরকার প্রধান নিজেই বলেছেন, এবং নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে, আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।”

“সুতরাং, আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য বিদেশিদের বলার দরকার নেই এবং রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশেরও কোনো প্রয়োজন নেই,” বলেন আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেন, “বিদেশিরা নির্বাচনের আগে এ ধরনের কথা বলে থাকেন। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ মাথায় রেখে সরকারকে চাপে রাখতেই তাঁরা এ ধরনের কথা বলেন। নির্বাচনের আগে বলার কারণ হলো, এই সময়ে সরকার চাপে থাকে এবং অনেক বেশি নরম থাকে।”

বিদেশিদের স্বার্থ কী?-এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “অনেক পশ্চিমা দেশ আমাদের কাছে সামরিক সরঞ্জামাদি বিক্রি করতে চায়। তারা আমাদের কাছে ডিসকাউন্ট দিয়ে যুদ্ধ বিমানসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা সেগুলো নাকচ করে দিয়েছি।”

আব্দুল মোমেন বলেন, “আবার জাতিসংঘকে বিভিন্ন এনজিওরা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল তথ্য ও কাগজপত্র সরবরাহ করে। দুঃখের বিষয় হলো জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা এই সকল ভুল তথ্য সাংবাদিকদের বলেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে কথা বললে মিডিয়ায় প্রচার পাওয়া যায় বিধায় তারাও এসকল কথা বলে মজা নেয়।”

উদ্বেগ কঠিন শব্দ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির ‘কনসার্ন’ (উদ্বেগ) শব্দটি ব্যবহারটি ঠিক হয়নি।

তিনি বলেন, “কনসার্ন অনেক কঠিন শব্দ। গৃহযুদ্ধ অথবা যে ক্ষেত্রে প্রতিদিন অনেক মানুষ সহিংসতায় মারা যাচ্ছে তেমন অবস্থার ক্ষেত্রে ‘কনসার্ন’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়।

ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “বাংলাদেশে পর পর দুটি সাধারণ নির্বাচন যেহেতু খুব ভালোভাবে হয়নি এবং দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যে, এখানে ‘আনইজিনেস’ আছে। এখানে কনসার্নড হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি।

তিনি বলেন, “জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির মুখ থেকে এই শব্দ ব্যবহারের একটি বার্তা আছে। আমার মনে হয়, তিনি এই শব্দ ব্যবহার করে সরকারকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়; আবার পুলিশও যেন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে।”

ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “আমি মনে করি না যে আবাসিক প্রতিনিধি বিরোধীদলকে সমর্থন করে এই কথা বলেছেন। তবে তাঁর এই শব্দ ব্যবহারে বিরোধীদল কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে একথা বলা যায়।”

সঠিক বলেছেন

প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বর্তমান সরকার দেশের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা ও সাংবিধানিক শাসনের সংস্কৃতি নষ্ট করেছে, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে এবং দেশের মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আর এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসাবে দেশে সহিংসতার জন্ম হতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে-এমন আশঙ্কা থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।”

“সম্ভাব্য সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করতে হবে। এর মাধ্যমেই দেশে একটি সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা হবে,” বলেন জহির উদ্দিন স্বপন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।