বিশেষজ্ঞদের মতে, আওয়ামী লীগের সংকট কাটতে সময় লাগবে
2024.10.28
ঢাকা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর এখন মাঠছাড়া হয়ে আছে টানা দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা দেশের সবচেয়ে পুরানো দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্মরণকালের অস্তিত্ব সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে দেওয়া দলটি।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ, মধ্যম এমনকি তৃণমূলের বেশিরভাগ নেতাদের দেখা যায় না। শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় একশো নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই হত্যা মামলার আসামি। দলের বিত্তবান ও প্রভাবশালী নেতাদের অনেকেই বিদেশে পালিয়েছেন, কেউবা দেশের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ প্রশ্ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়।
ইতোমধ্যে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বলে পরিচিতি এবং দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিত ছাত্রলীগকে গত ২৪ অক্টোবর নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সোমবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ রিট আবেদন করেছেন মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার’ দাবি জানিয়ে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমিতে এক আলোচনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয় হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিচার করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারলেও খুবই কম সংখ্যক আসন পাবে।
বসে নেই আওয়ামী লীগ
গত সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঢাকা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা মিছিল করেছেন। নিম্ন আদালতে আওয়ামীপন্থী আইনজীবী জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ভিন্ন সংগঠনের আড়ালে সমাবেশ করতে গিয়ে মার খেয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চ্যালেঞ্জ থাকলেও নেতাকর্মীরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বেনারকে বলেন, আওয়ামী লীগ সবচেয়ে পুরানো দল, যার বয়স ৭৫ বছর, “এবারের মতো বড়ো সংকটে আওয়ামী লীগ পড়েনি।”
তাঁর মতে, দলটির বিরুদ্ধে শত শত মানুষ হত্যা, নেতাদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগের কারণে “দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা” থাকলেও “সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ অনেক বড়ো এবং দেশের একটি অংশের মধ্যে শক্ত সমর্থন রয়েছে। ফলে “হয়তো তারা ঘুরে দাঁড়াবে। তবে অনেক সময় লাগবে।”
তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদেশে অবস্থানরত নেতারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। কিছুদিন পর নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করবেন।”
প্রসঙ্গত, অজ্ঞাতস্থান থেকে গত সপ্তাহে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এক ফেসবুক লাইভে এসে বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেছেন এবং ছাত্র আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন বলেছেন।
অজ্ঞাতস্থান থেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম সোমবার বেনারকে বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যার নেতাকর্মী, সমর্থক দেশের প্রতিটি গ্রামে, এমনকি পাড়া-মহল্লায় রয়েছে।
তিনি বলেন, “অতীতেও বহুবার সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা কেবল সময়ের অপেক্ষায়, দেখবেন রাজনৈতিকভাবে দল ঘুরে দাঁড়াবে।”
নাসিম বলেন, “ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর মতো কর্মকাণ্ড চালালে তা কি দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে? তাই বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।”

বিচার চাইলেও নিষেধাজ্ঞা চায় না অন্যান্য দল
বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিচার দাবি করলেও দলটিকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন সোমবার বেনারকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী যারা “গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করেছে তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”
তবে তাঁর দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করলে কী পরিণতি হতে পারে সেটি আমরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে শিখেছি। সে কারণেই তাদেরকে নিষিদ্ধ করা সঠিক হবে না।”
“আমরা চাই, ভোটের মধ্যে দিয়ে জনরায়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিচার,” যোগ করেন জহির উদ্দিন স্বপন।
এর আগে বিএনপির মহাসচিব মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র চাই তাহলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হবে কেন? জনগণকে দলটির ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা “ঠিক হবে না” বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামীও।
দলটির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আইনগতভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়তো ঠিক হবে না। আমাদের কথা হলো বিগত দিনে যারা গণহত্যা চালিয়েছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করেছে তারা রাজনীতি করতে পারবে কি না সে ব্যাপারে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মতে, “বিএনপি-জামায়াত কেউই চাইবে না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক।”
তিনি বেনারকে বলেন, “বিএনপি মনে করে আগামী নির্বাচনে তারা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে এবং এই নির্বাচনকে বৈধতা দিতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। নতুবা ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠবে।”
তাঁর মতে, এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ “ঘুরে দাঁড়াবেই।”
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক সামছুল আলম এই প্রত্যাশার সাথে একমত নন।
তিনি বেনারকে ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি দেশের মানুষের সহানুভূতি ছিল। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনা আটক হলে দল ভাঙনের মুখে পড়লেও সামলে ওঠে। তবে ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
“দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে বিপদে ফেলে শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতে পালিয়ে গেলেন সেটি নেতৃত্বের সংজ্ঞায় পড়ে না। তাই এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ফিরে আসা কঠিন,” বলেন তিনি।
“নেতাদের মধ্যে যারা হত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাট করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। সেক্ষেত্রে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে আওয়ামী লীগ। এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে অংশ নিলেও দলটি হয়তো খুব কম আসন পাবে,” বলেন অধ্যাপক সামছুল।