চিত্রনায়িকা পরীমনির ৩ দফা রিমান্ড: উচ্চ আদালতে নিম্ন আদালতের কড়া সমালোচনা
2021.09.01
ঢাকা

মাদক মামলায় গ্রেপ্তারের পর চিত্রনায়িকা পরীমনিকে তিন দফায় সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার ঘটনায় নিম্ন আদালতের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে অধিকাংশ মামলার আসামিদের জন্য পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করছে আদালত।
এই প্রেক্ষাপটে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ বুধবার ওই সমালোচনা করে, যা মানবাধিকার কর্মীরা সমর্থন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সচরাচর উচ্চ আদালত এভাবে কঠোর সমালোচনা করে না।
পরীমনির অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে ২৫ আগস্ট হাইকোর্টে করা আবেদন এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আবেদনের ওপর শুনানিকালে নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, “রিমান্ডের উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিলো, আপনি মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী শাহিনুজ্জামান শাহিন আদালতের এই মন্তব্য সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত আরও বলেছেন, রিমান্ড বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে একটি নির্দেশনা দেয়া হবে।”
গত ৪ আগস্ট রাজধানীর বনানীর বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন পরীমনি। আটকের সময় তাঁর বাসায় কয়েক বোতল মদ এবং কিছু নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এ ব্যাপারে বনানী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
আটকের পর পরীমনিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আইন অনুযায়ী তাঁকে আদালতে তোলা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রথম দফায় চার দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করে। প্রথম দফা রিমান্ড শেষে আরেক দফা রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। তখন আরও দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এরপর আরেক দফা রিমান্ড আবেদন করলে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
মঙ্গলবার বিচারিক আদালত থেকে জামিন পাবার পর বুধবার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন পরীমনি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর হাতে দেখা যায় মেহেদীর রঙে ইংরেজিতে লেখা ডোন্ট, এরপর তিনটি হৃদপিণ্ডের চিহ্ন, তারপর ‘লাভ মি বিচ’ এবং সর্বশেষ উত্থিত মধ্যমা।
তাঁর হাতের এই বার্তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হওয়া যায়নি। তবে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তাঁকে উৎফুল্ল দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরীমনির ওই হাতসহ ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে।
পরীমনিকে তিনদফা রিমান্ডে নেওয়া প্রসঙ্গে বুধবার শুনানিতে উচ্চ আদালতের ওই বেঞ্চ বলে, এই মামলায় কী এমন ছিল যে বার বার রিমান্ডে নিতে হবে?
আইনজীবী শাহিন বলেন, “আদালতে আমরা বলেছি, রিমান্ড প্রদানের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের দেয়া নির্দেশনা পরীমনির ক্ষেত্রে মানা হয়নি।”
‘রিমান্ড সকল আসামির জন্য নয়’
১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে সন্দেহজনক কারণে পুলিশের হাতে আটক হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেল। ওই বছর ২৩ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মারা যান রুবেল।
ওই ঘটনায় জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নিরসনের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে সরকার।
পুলিশের হাতে নির্বিচারে মানুষকে আটক হওয়া এবং রিমান্ডে নেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) রিট আবেদন দাখিল করে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নেতৃত্বে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ও ব্যক্তি।
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এই রিট আবেদনের ওপর রায় দেন বিচারপতি হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী। রায়ে পুলিশের জন্য এ সংক্রান্ত ১৫টি নির্দেশনা দেয় আদালত।
পুলিশি রিমান্ড প্রশ্নে রায়ে বলা হয়, পুলিশ রিমান্ডে কোনো আসামিকে নির্যাতন করতে পারবে না এবং একটি কাচের ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে যাতে বাইরে থেকে বোঝা যায় কীভাবে ওই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামির কোনো স্বজন অথবা আইনজীবী রিমান্ড কক্ষের বাইরে থেকে বিষয়টি দেখবেন।
একইভাবে নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনেও কোনো আসামিকে রিমান্ডে নেয়া এবং রিমান্ডের সময় করণীয় বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখছি যে মামলাই হোক না কেন, পুলিশ আদালতে রিমান্ড চাইলেই আদালত থেকে তা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশি রিমান্ড খুব সাধারণ একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “অথচ রিমান্ড সকল আসামি অথবা সকল মামলার জন্য নয়। যখন কোনো আসামির কাছ থেকে জটিল কোনো বিষয়ে স্বল্পতম সময়ে তথ্য পাওয়া যায় না, তখন তাঁকে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এটা সাধারণ কোনো বিষয় নয়।”
অধ্যাপক মিজানুর বলেন, “পুলিশি রিমান্ড সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, রিমান্ডে নির্যাতনের মাধ্যমে আসামিদের কাছ থেকে কিছু স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়, যা সাধারণভাবে একজন আসামি করেন না। একজন আসামি রিমান্ডে বিভিন্ন স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকেন নির্যাতন থেকে বাঁচতে।”
তিনি বলেন, “রিমান্ড নিয়ে আজকে আদালত যে মন্তব্য করেছেন এটি সত্যিই সময়োপযোগী।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “রিমান্ড নিয়ে আদালতের বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে পুলিশ রিমান্ডের অপব্যবহার করছে। গত কয়েক বছর ধরে এই অপব্যবহার চলছে।”
তিনি বলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরে জঙ্গিবাদসহ কিছু মামলার সংবেদনশীলতার কারণে আমরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। এটি আমাদের এক ধরনের অসততা আমি বলব।”
নূর খান বলেন, “জঙ্গিদের রিমান্ডে নেওয়ার ব্যাপারে যেহেতু সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি সেহেতু পুলিশ রিমান্ড বিষয়টির অপব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। আবার আদালতের পক্ষ থেকে অনবরত রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “পুলিশ রিমান্ড চাইলেই যদি তা মেলে তাহলে তো আদালত থাকার কোন দরকার ছিল না। আজকে উচ্চ আদালত থেকে রিমান্ডের ব্যাপারে বিচারিক আদালতের যে সমালোচনা এসেছে সেটি একটি ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও মানবাধিকার রক্ষা পাবে।”