গুরুত্বহীন বিবেচিত রাষ্ট্রপতির পদ হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রে
2024.10.25
ঢাকা

সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বহীন একটি আলঙ্কারিক পদ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই মাসের মাথায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।
হাসিনা সরকার পতনের মূল শক্তি ছাত্রদের মধ্য থেকে দাবি উঠেছে সাহাবুদ্দিনের অপসারণ, সরকারও এই দাবি বাস্তবায়নের উপায় খুঁজছে।
এদিকে নির্বাচিত সংসদ ছাড়া রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের কোনো আইনগত বিধান না থাকায় বর্তমানে পদটি শূন্য হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
“রাষ্ট্রপতি নিয়ে যে সংকট দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বের হতে দেশের সংবিধানে কোনো রকমের সুযোগ নেই,” শুক্রবার বেনারকে বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
সংবিধান অনুযায়ী, পদটি শূন্য হলে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন সংসদের স্পিকার, স্পিকারের অবর্তমানে ডেপুটি স্পিকার। কিন্তু দ্বাদশ সংসদের স্পিকার শিরীন শারিমন চৌধুরী গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ১৪ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন।
নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এখতিয়ার একমাত্র জাতীয় সংসদেরই রয়েছে উল্লেখ করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের “উপদেষ্টা পরিষদ কীভাবে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবে?”
যেতে হবে সংবিধানের ‘বাইরে’
সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের অবর্তমানে রাষ্ট্রপতিই দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রথম সপ্তাতেই সর্বোচ্চ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে গত ৫ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ পাঠ করানো এবং ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নিয়োগ।
সেনাপ্রধান নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারে। সংসদের অবর্তমানে রাষ্ট্রপতির সেনাপ্রধানকে বরখাস্তের উদাহরণও রয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান মোহাম্মদ নাসিমকে বরখাস্ত করে সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিহত করেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস, যিনি ছিলেন বিএনপি সরকারের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।
বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে ১৯৭৭ ও ১৯৮১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান স্থগিত রেখে, সামরিক আইন জারি করে আইনগত বিষয়গুলো মোকাবেলা করা হয়েছিল। কিন্তু গত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি, সামরিক আইনও জারি করা হয়নি। ফলে, সংবিধান কার্যকর রেখে সরকার কীভাবে সংবিধানের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বিষয়টি সুরাহা করবে তা পরিষ্কার নয়।
রাষ্ট্রপতির অপসারণ সংক্রান্ত বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিটি “অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক” তুলে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তাঁর মতে, রাষ্ট্রপতি স্বপদে থাকলেও “কোনো সমস্যা ছিল না।”
অনিবার্য কারণে যদি এখন পদটি শূন্য হয় তবে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বা বিশেষ প্রয়োজনের নীতি অনুসরণ করে “সংবিধান থেকে বের হয়ে” রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই বলে মত দেন তিনি।
তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে আবার এই সিদ্ধান্তের “বৈধতা” নিশ্চিত করতে হবে পরবর্তী সরকারকে। “এর বাইরে অন্য সুযোগ নেই।”
এদিকে ষাটের দশকে প্রয়োগ করা ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ আজকের বাংলাদেশে কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করা বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা অতি অল্প ছিল ইঙ্গিত করে তিনি বেনারকে বলেন, “পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ কি আছে যেখানকার দুইশ-পাঁচশ জন লোক সে দেশের রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় না? বঙ্গভবনের সামনে ৩০০ ছাত্র আন্দোলন করল আর রাষ্ট্রপতির অপসারণের জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলো- ব্যাপারটা কি এত সহজ?”

রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের ‘উত্তরাধিকার’
ছাত্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।”
কিন্তু সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা যে পদত্যাগ করেছেন, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।
এর প্রতিক্রিয়ায় গত সোমবার সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গণমাধ্যমকে বলেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন এবং শপথ ভঙ্গ করেছেন।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ একটি মীমাংসিত বিষয়। এই বিষয় নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করতে ওই দিন গণভবন থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সকলের প্রতি আহ্বান জানালেও শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন স্থানে ছাত্ররা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে।
এরপর গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির অপসারণ এবং অবিলম্বে সংবিধান বাতিল এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নসহ পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন।
“রাষ্ট্রপতি এখনও হাসিনার ফ্যাসিবাদের উত্তরাধিকার বহন করছেন যা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেতনার বিরুদ্ধে। তাই তাঁকে যেতেই হবে,” বলেন হাসনাত।

উপায় খুঁজছে সরকার, বিএনপির ভিন্নমত
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ “একটি রাজনৈতিক বিষয়” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের সরকার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। তাই প্রত্যেকটা বিষয় সংবিধানের আলোকে হবে কি না তা দেখার বিষয়।”
এর আগে বুধবার রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে বিতর্কের মধ্যে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে।
দলটির অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যেহেতু এই মুহূর্তে দেশ সংকটময় পরিস্থিতি পার করছে তাই আমাদের দল মনে করে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে এমন উদ্যোগ না নেয়াই উত্তম।”
তিনি বলেন, “বিএনপি মনে করে যেহেতু রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগে একটি সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, সেহেতু আপাতত এই ধরনের উদ্যোগ না নেয়াই উত্তম।”
তবে বিষয়টি নিয়ে সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে বলেও মনে করেন বিএনপির এই নেতা। কোনো অবস্থাতেই হুট করে কিছু করা উচিত হবে না বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে আহম্মদ ফয়েজ।