সয়াবিনের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.05.05
ঢাকা
সয়াবিনের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা বোতলজাত তেলের সংকটের কারণে ঢাকার কাওরান বাজারে বোতলে করে খোলা তেল কিনছেন একজন ক্রেতা। ৫ মে ২০২২।
[বেনারনিউজ]

বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম বৃদ্ধি এবং পামওয়েল রপ্তানির ওপর ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞার কারণে গত কয়েক সপ্তাহজুড়ে সংকটের পর সয়াবিন ও পামওয়েলের খুচরা দাম নজিরবিহীনভাবে বাড়িয়েছে সরকার।

শুক্রবার থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা থেকে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকায় বিক্রি করা হবে। লিটারে ৩৭ টাকা বাড়ায় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৮০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি লিটার পামওয়েলর দাম ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের বৈঠকের পর সংগঠনটির পক্ষ থেকে নতুন এই দাম বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, রোজা ও ঈদের আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়াতে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছে।

তাঁদের মতে, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় দেশেও দাম বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, তবে একসাথে লিটারে প্রায় ৪০ টাকা বৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেবে।

দাম না বাড়ালে ব্যবসায়ীরা তেল আনবেন না: বাণিজ্যমন্ত্রী

বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সাথে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

“সারাবিশ্বে ভোজ্যতেলের সংকট চলছে,” জানিয়ে মন্ত্রী বেনারকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রড সয়াবিন তেল প্রতি টন এক হাজার ৪৫৭ ডলার থেকে টন প্রতি দুই’শ ডলার বেড়েছে।

একইভাবে আগে যেখানে ক্রড পামওয়েল প্রতি টন ১২০০ ডলারে বিক্রি হতো, ইন্দোনেশিয়া পামওয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর সেই দামও “অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে” বলে জানান মন্ত্রী।

“এই অবস্থায় দাম বৃদ্ধি না করলে ব্যবসায়ীরা তো তেল আনবেন না। বিশ্ববাজার যেদিকে যাচ্ছে তাতে সামনের দিনগুলোতে সমস্যা বাড়তে পারে,” বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

তবে সাধারণ মানুষকে এই দাম বৃদ্ধি থেকে রেহাই দিতে টিসিবি’র মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে এক কোটি লিটার তেল বিক্রি অব্যাহত রাখা হবে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসাবে একসময় সরিষার তেল ব্যবহার করা হতো। ১৯৬০ এর দশক থেকে বাংলাদেশে সয়াবিনের প্রচলন শুরু হয়। আশির দশক থেকে পামওয়েলের ব্যবহার বাড়তে থাকে।

কয়েক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্যতেল হিসাবে একচেটিয়া বাজার দখল করে সয়াবিন। এরপরই রয়েছে পামওয়েলের স্থান।

সয়াবিন মূলত আমদানি করা হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হয় পামওয়েল।

সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর কমবেশি ৩০ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়, যার শতকরা ৪০ ভাগের বেশি পামওয়েল। সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ পামওয়েল ব্যবহার করেন।

এ ছাড়া বেকারি শিল্পে একচেটিয়া পামওয়েল ব্যবহৃত হয়।

গত সপ্তাহে বিশ্বের প্রধান উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া পামওয়েল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করলে পামওয়েল এবং সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে থাকে।

তবে দাম বাড়ার আগে থেকেই দেশের বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট শুরু হয়। অল্প কিছু দোকানে তেল মিললেও দাম ছিল ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি।

জনগণের কষ্ট বাড়ল

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পেলে দেশের বাজারে দাম বৃদ্ধি পাবে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সবাই যে বাড়তি দামে ভোজ্যতেল কিনেছেন সেটি ঠিক নয়।”

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে কিছু ব্যবসায়ী তাঁদের হাতে থাকা অল্প দামে কেনা ভোজ্যতেল বাজারে ছাড়েনি। ফলে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়ীদের বড়ো অংশই সবসময় মুনাফা লাভের চেষ্টা করেন। জনগণের কষ্ট তাঁদের বিবেচ্য বিষয় নয়।”

“তবে দাম বৃদ্ধির একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। এখন বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট কিছুটা হলেও কমবে,” মন্তব্য করে গোলাম রহমান বলেন, “আশা রাখি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে ভোজ্য তেলের দাম কমাবে সরকার।”

তবে তাঁর মতে, সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন ধরনের তেল যেমন রাইসব্র্যান ওয়েল, সরিষা, সূর্যমুখী, সয়াবিন ইত্যাদির দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে।

বাজারে পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যায় না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়তে থাকে তখন সরকারের উচিত কোনো একটি মাধ্যম দিয়ে বাজারে সেই পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করা।

তিনি বলেন, “যেমন টিসিবি’র মাধ্যমে যদি সরকার বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে তাহলে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে না। কিন্তু আমরা বরাবর যা দেখি সেটি হলো, টিসিবি’র মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনো ধরনের অসততা অথবা দুর্নীতি এসে যায়। সেকারণে সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যায় না।”

“আবার দেখা যায়, একটি পণ্য কয়েকজন আমদানিকারকরাই আমদানি করেন। তাঁরা যখন সিন্ডিকেট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করে, তখন সরকারের কিছু করার থাকে না। সব সরকারের আমলেই একই অবস্থা দেখা যায়,” বলেন মিজানুর রহমান।

তাঁর মতে, “সরকারের পক্ষ থেকে যাঁদের বিষয়টি তদারকির কথা, সেই মন্ত্রী অথবা এমপি অথবা কোনো সরকারি কর্মকর্তা নামে-বেনামে ওই পণ্যের ব্যবসা করেন। ফলে যিনি আমদানিকারক তিনিই তদারককারী।”

চলতে পারছি না

ওষুধ কোম্পানি রেনাটার একজন কর্মচারী মো. আরিফ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “দেশের মানুষ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। বাঁচতে হলে কিনতে হবে। ব্যবসায়ীরা যেভাবে দাম নির্ধারণ করবে আমাদের সেই দামেই কিনতে হবে। এটিই বাস্তবতা।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে বর্তমানে চাল, ডাল, তেল প্রতিটি দ্রব্যের দাম অনেক। বলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এক টাকা বৃদ্ধি করলে ব্যবসায়ীরা বৃদ্ধি করে তিন টাকা।”

আরিফ বলেন, “অবস্থা এমন যে, দেশের মধ্যবিত্ত শেষ হয়ে যাবে। কারণ তাদের তো আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমার বর্তমান অবস্থা এমন যে আমি আমার পরিবারকে বগুড়ায় পাঠিয়ে দেবো। এখানকার খরচে চলতে পারছি না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।