অধিকার-এর নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্তে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের উদ্বেগ
2022.06.10
ঢাকা

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়ন না করার সরকারি সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার রাভিনা শামদাসানি। অপরদিকে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধমূলক বলে আখ্যায়িত করেছে ১১টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনারের ওয়েবসাইট ও যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইট থেকে দুটি পৃথক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
দুটি বিবৃতিতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি করা হয়।
“আমরা অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি, এবং অধিকার যাতে যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে সম্পূর্ণ বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা করার সুযোগ পায় তা যেন নিশ্চিত করা হয়,” বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার শামদাসানি।
“আমরা আরও উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নাগরিক সমাজের যেসব সংগঠন জাতিসংঘের মানবাধিকার ব্যবস্থায় রিপোর্ট করে, তাদের কার্যক্রমের ওপর এর প্রভাব পড়বে,” বলেন শামদাসানি।
অধিকার বহু বছর ধরে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নথিভুক্ত করেছে এবং রিপোর্ট করেছে, যার মধ্যে জাতিসংঘের বিশেষ কার্যপ্রণালীতে প্রাধান্য পাওয়া বিষয়গুলোও রয়েছে, বলা হয় এই বিবৃতিতে।
২০১৩ সাল থেকে অধিকারকে ভীতি প্রদর্শন এবং প্রতিশোধমূলকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, দাবি করে এতে বলা হয়, নিবন্ধন নবায়ন না করার ক্ষেত্রে সংগঠনটির বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ এবং ‘সরকারবিরোধী’ কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ আনায় সন্দেহ আরও তীব্র হয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অধিকারের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে দাবি করে এতে বলা হয়, গত এক দশক ধরে জাতিসংঘকে সহযোগিতা দেয়া সংগঠন অধিকার-এর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আচরণের বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
গত ৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অতিরিক্ত সচিব জিনাত আরা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, অধিকার এর নিবন্ধন ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ উত্তীর্ণ হয়েছে এবং অধিকার-এর নবায়ন আবেদনপত্রে অসঙ্গতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না দেয়া এবং বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কিত ব্যাখ্যা না দেয়া এবং ‘রাষ্ট্রের সুনাম ও ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ণ করার কারণে সংস্থার কার্যক্রম সন্তোষজনক না হওয়ায় অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়নের আবেদনটি বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
২০১৪ সাল থেকে অধিকার-এর আবেদন ঝুলন্ত থাকায় এবং এ সময়ে সংগঠনটি ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকায় এর কাজ পরিচালনার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা অধিকারকে তার ব্যাংক হিসবে অ্যাক্সেসের অনুমতি দেওয়ার জন্য আহবান জানাই।”
সংগঠন পরিচালনার স্বাধীনতা রহিত করা আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার পরিপন্থী দাবি করে, জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সরকারকে প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই সুশীল সমাজের কাজ করার জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তোলার আহবান জানাই, বিশেষ করে পরবর্তী নির্বাচনের আগে।”
সুশীল সমাজের কর্মীদের অবশ্যই জাতিসংঘ, এর প্রতিনিধি এবং ব্যবস্থার সাথে সহযোগিতা করতে বাধা দেওয়া উচিত নয়, বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার জেরে হয়রানি
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ১১টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন যৌথ বিবৃতিতে দাবি করে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকারকর্মী ও সংগঠনগুলোর ওপর যেরকম ‘প্রতিশোধমূলক’ হয়রানি চালিয়ে আসছে অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়ন না করাও তেমনি মনে হচ্ছে।
অবিলম্বে অধিকার-এর নিবন্ধন বাতিল করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সংগঠনগুলো বলছে, “সরকারের উচিত কোনো প্রকার প্রতিশোধ, ভয়ভীতি এবং হয়রানি ছাড়াই মানবাধিকারকর্মীদের কাজ পরিচালনার অনুমতি দেওয়া।”
বিবৃতিতে বলা হয়, নিবন্ধন নবায়নে সরকারের নিষ্ক্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হয় অধিকার এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে এনজিও ব্যুরোর কাছে ব্যাখ্যা চায় হাইকোর্ট।
“কিন্তু হাইকোর্টকে কোনো জবাব না দিয়ে বিষয়টি বিচারাধীন রেখেই যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অধিকার-এর আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে ব্যুরো,” বলা হয় এতে।
সংস্থাগুলো বলেছে, কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন করা, প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে অধিকারকে কাজ পরিচালনার অনুমতি দেওয়া এবং দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি লিপিবদ্ধ করার কাজটিকে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতির সুযোগ হিসেবে নিয়ে তাদের অনুসন্ধানকে স্বাগত জানানো।
‘প্রতিশোধমূলক কাজ সরকার করে না’
যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর গুমের শিকার পরিবারগুলো অভিযোগ করছে, তাঁদের বাসায় বাসায় গিয়ে পুলিশের সদস্যরা সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে অথবা অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন।
তবে হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ বলছে তদন্তের অংশ হিসেবেই ভুক্তভোগীদের বাড়িতে যান তাঁরা।
অপরদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছেন, র্যাবের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হলে মানবাধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকায় একাধিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে হাস বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সহজ এবং তড়িৎ কোনো পথ নেই।
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আবেদন নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি প্রতিনিধি দলও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে এসেছে।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি না পাওয়ায় সংস্থাটির অপারেশন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের জানিয়েছে ওই সংসদীয় দল।
এদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রীসভার জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক শুক্রবার বেনারকে বলেন, সরকার যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই অধিকার-এর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
“সরকার সকল কাজ নিয়মের ভিতরে থেকেই পরিচালনার চেষ্টা করে। প্রতিশোধমূলক বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কোনো কাজ সরকার করে না,” বলেন মন্ত্রী।
গত বুধবার অধিকার বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি শুনানি হবার কথা থাকলেও অধিকার-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানিটি পিছিয়ে আগামী বুধবার নেয়া হয়েছে জানিয়ে, সংগঠনটির আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “আমরা সকল প্রকার কাগজপত্র ও চাহিত তথ্য এনজিও ব্যুরোকে দিয়েছিলাম। এই বিষয়টি আদলতে লিখিতভাবে অবগত করেছি।“
তিনি বলেন, যেহেতু বিষয়টি বিচারাধীন তাই অধিকার-এর পক্ষ থেকে আদালতকে এ বিষয়ে অবগত করা হয়েছে।
২০১৩ সালের মে মাসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ধর্মঘটের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হেফাজতকর্মীদের সংখ্যা প্রকাশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে অধিকার-এর টানাপোড়েন শুরু হয়।
সে সময় অধিকার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, হেফাজতকে মতিঝিলের সমাবেশ থেকে সরিয়ে দিতে যে অপারেশন পরিচালিত হয় তাতে ৬১ জন মারা যায়।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১০ আগস্ট ২০১৩ আটক হন অধিকার সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।