শিক্ষার্থী ধর্ষণের বিচার দাবিতে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
2020.01.06
ঢাকা

রাজধানী ঢাকার রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ধর্ষককে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে রোববার রাত থেকে শুরু মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনসহ ও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। চলে সোমবার সারাদিন। ধর্ষককে গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন তাঁরা।
সোমবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ মিছিল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, এ ঘটনার দায় সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এড়াতে পারে না। তারা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
“৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা না হলে সারা দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে,” হুঁশিয়ার করেন তিনি।
এই ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সোমবার বিকেলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গতকালের ঘটনার তদন্ত চলছে, সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবগুলো সংস্থা ঘটনাটি তদন্ত করছে।”
দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার একদিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ওই ঘটনায় সোমবার সকালে অজ্ঞাত পরিচয় একজনকে আসামি করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগীর বাবা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি শাহান হক বেনারকে বলেন, “এ ঘটনার তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল শনাক্ত করা হয়েছে। আসামি শনাক্ত ও আটকের কাজ চলছে।”
ওই শিক্ষার্থীর বরাত দিয়ে ঢাকা মেডিকেল ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী শেওড়ায় বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার জন্য রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে ওঠেন।
তবে ভুল করে তিনি ঢাকা সেনানিবাসের কাছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বাস থেকে নেমে পড়েন। এরপরপরই অজ্ঞাত পরিচয় একজন তাঁর মুখ চেপে ধরে নিয়ে যায়। পরে ধর্ষণ করা হয়।
রাত ১০টার দিকে রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে পড়ে থাকা ওই ছাত্রীর জ্ঞান ফিরলে তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বান্ধবীর বাসায় যান। সেখানে ঘটনাটি জানানোর পরে তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। বর্তমানে সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষার্থী ধর্ষণের খবর পেয়ে রোববার রাতেই প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সোমবার সারাদিন এই ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ ও ধর্ষককে গ্রেপ্তার এবং বিচারের দাবিতে দিনভর স্লোগানে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস।
ওই ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে কয়েক ঘণ্টার জন্য শাহবাগ মোড় অবরোধ করে ১২টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত নতুন জোট- সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্য। এতে পুরো এলাকা স্থবির হয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থী ধর্ষণের বিচার চেয়ে রোববার ভোর চারটা থেকে ক্যাম্পাসে অনশনে বসেছেন দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিফাতুল ইসলাম।
তিনি বেনারকে বলেন, “ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে হবে। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।”
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বেনারকে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে ধর্ষণের শিকার একজন ব্যক্তি হলেও তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে দুর্বিষহ এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাই জঘন্যতম এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।”
আইন ও বিচারের ঘাটতিই কারণ
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। সদ্য বিদায়ী বছরের শেষ দিনে এই প্রতিবেদন প্রকাশের ছয় দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় ঘটল।
খোদ রাজধানীতে রাস্তায় একজন নারীকে এভাবে ধর্ষণের ঘটনায় শহরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আইন ও বিচারে ঘাটতির কারণেই ধর্ষণের বাড়ছে।
আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বেনারকে বলেন, “ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক একটা কাজও দেশে হচ্ছে না। এই শহর নারীদের জন্য নিরাপদ করতে ব্যর্থ হয়েছে সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বরং কেউ বিপদে পড়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হাত বাড়ালে আরো নিপীড়ন বাড়ে।”
বিচার বিভাগও ব্যর্থ হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য ধর্ষণের ঘটনার কোনো বিচার বা তার প্রয়োগ চোখে পড়েনি। নিম্ন আদালতে কিছু বিচারের রায় হলেও উচ্চ আদালতে এসে আর অগ্রগতি হয় না।”
ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে বিদ্যমান আইনে অনেক ঘাটতি রয়েছে অভিযোগ করে এসব আইনের রিভিউ করা দরকার বলে জানান এই মানবাধিকার কর্মী।
“তা ছাড়া সারা দেশে ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে সারাক্ষণ নারী ও শিশুর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, যা ধর্ষণ করতে প্রলুব্ধ করে,” বলেন শীপা হাফিজা।
শিক্ষার্থী ধর্ষণে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও।
এক বিবৃতিতে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক বলেছেন, “আমাদেরই সন্তানতুল্য একজন ছাত্রীর প্রতি এহেন পৈশাচিক উন্মত্ততায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, বেদনাক্লিষ্ট ও ক্ষুব্ধ।”
তাঁরা বলেন, “ধর্ষণ একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরণিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৈথিল্য, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং কখনো কখনো সঠিক তদন্তের অভাবে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় সমাজে ধর্ষণ-ব্যাধির বিস্তার ঘটে চলেছে। এখনই এসবের মূলোৎপাটনে রুখে দাঁড়াতে হবে, নতুবা এটি অধিকতর মহামারি আকার ধারণ করবে।”
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই শিক্ষার্থীকে দেখতে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা মর্মাহত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ছাত্রীটির পাশে আছি। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা প্রয়োজন তাই করবে।”
ধর্ষণের আলামত মিলেছে
ফরেনসিক পরীক্ষায় ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে বলে সোমবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ।
তিনি জানান, “মেয়েটির গলায় আঙুলের দাগ রয়েছে। তাঁর গলা টিপে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁর হাতে-পায়ে আঘাত রয়েছে। সারা পায়ে খোঁচা লাগার দাগ রয়েছে। ঝোপের মধ্যে ধর্ষণের কারণে এ দাগ হতে পারে।”
মেয়েটি ট্রমা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন বলেও জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
এদিকে ওই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনাস্থল চিহ্নিত করে সেখানকার ঝোপের মধ্যে মেয়েটির ইনহেলার, ক্লাসের নোটবুক, লেকচার শিট, চাবির রিং সংগ্রহ করেছে পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “ক্রাইম সিন থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তিরও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ধর্ষক একজন।”