ইউক্রেনের ভূমি দখল: জাতিসংঘে রাশিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ
2022.10.13
ঢাকা

সামরিক বাহিনী দিয়ে দখলের পর অবৈধ গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে নিজেদের ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্তির নিন্দা জানাতে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর এই প্রথম রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিলো বাংলাদেশ।
বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১১তম জরুরি সভায় এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১৪৩টি দেশ। মোট ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত ও পাকিস্তান।
পূর্ব ইউরোপের মুসলিম-প্রধান দেশ আলবেনিয়ার উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবের বিপক্ষে এবং রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেয় রাশিয়া, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, নিকারাগুয়া এবং সিরিয়া।
এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর এই প্রথমবারের মতো রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়ে ভোট দিলো বাংলাদেশ।
কারণ হিসাবে সরকার বলছে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের নীতি অনুযায়ী সকল দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভূখণ্ড দখল করা ঢাকা সমর্থন করে না ।
এর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে নেয়া প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে বাংলাদেশ। তবে, গত মার্চে ইউক্রেনে মানবিক সাহায্য প্রদান সম্পর্কিত জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশ।
যুদ্ধ বা অবরোধ কোনো মঙ্গল আনে না
বৃহস্পতিবার (বাংলাদেশ সময়) জাতিসংঘের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই প্রস্তাব পাশের ফলে সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি রাশিয়ার দখলকৃত চার রাজ্যকে স্বীকৃতি না দিতে আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানালো ১৯৩ সদস্যের জাতিসংঘ। একইসাথে রাশিয়াকে এই অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধ করতেও আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।
আলবেনিয়ার আনা প্রস্তাবের বিষয় ছিল “ইউক্রেনের অখণ্ডতা: জাতিসংঘ সনদের নীতি রক্ষা।”
“বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময় বিশ্বের সব স্থানে সকল বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে এবং জাতিসংঘের নীতি ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সকল রাষ্ট্রের ভৌগলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে মেনে চলতে হবে,” রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়ার ব্যাখ্যায় এক বিবৃতিতে জানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়, “ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিন ও অন্যান্য আরব দেশের ভূমি দখলের বিরুদ্ধে একই রকমের অবস্থান গ্রহণ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপারে বাংলাদেশ “গভীরভাবে উদ্বিগ্ন” জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা বিশ্বাস করি, যুদ্ধ অথবা অর্থনৈতিক অবরোধ, পাল্টা-অবরোধ কোনো দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। সংলাপ, আলোচনা এবং মধ্যস্থতা হলো যে কোনো সংকট ও বিরোধ মেটানোর সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা।”
এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ছয়গুণ বেশি আয়তনের দেশ ইউক্রেনকে চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে রুশ বাহিনী।
শুরুতে সামরিক সফলতা পেলেও কিছুদিনের মধ্যেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে পর্যদুস্ত হতে থাকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। রাশিয়ার সরকারি হিসাবে, যুদ্ধের ছয় মাসে প্রায় ছয় হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, লাভিভ ও খারকিভ থেকে সৈন্য সরিয়ে রুশ বাহিনী রাশিয়ার পশ্চিম পাশের চার রাজ্য লুহানস্ক, ডোনেস্ক, খেরসন ও জাপরিঝঝিয়াতে সামরিক অভিযান বৃদ্ধি করে এবং সেগুলো দখল করে নেয়। তবে সেপ্টেম্বর মাসে খেরসন রাজ্যে সামরিক সফলতা লাভ করে ইউক্রেনীয় বাহিনী।
এই প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর ২৩ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে ওই চার রাজ্যে গণভোট আয়োজন করে রাশিয়া। এই গণভোটের ফলাফল অনুযায়ী মস্কো বলছে, ওই চার রাজ্য শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি ভোটার রাশিয়ান ফেডারেশনে যুক্ত হতে চান।
সেই গণভোটের পর পুতিন ইউক্রেনের ওই চার রাজ্যকে নিজেদের ভূমি হিসাবে ডিক্রি জারি করেন এবং পরে সেটি রাশিয়ার আইনসভায় পাশ হয়।
তবে ইউক্রেন ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মতে, ওই গণভোটে কোনো ইউক্রেনীয় ভোটার অংশ নেননি এবং রাশিয়ার সেনা এবং রুশপন্থী বিদ্রোহীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং রাস্তায় মানুষদের দাঁড় করিয়ে ব্যালটে স্বাক্ষর নিয়েছে।
রাশিয়ার এই ভূমি দখলের সিদ্ধান্তকে অগ্রহণযোগ্য বলে নাকচ করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো। এই গণভোট ও ভূমি দখলকে নিন্দা জানাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে আলবেনিয়া, যা সমর্থন করে বাংলাদেশ।
রাশিয়া কী মনে করল বিবেচ্য নয়
নিন্দা প্রস্তাবে সমর্থন দেওয়ায় রাশিয়া কী মনে করল সেটা বাংলাদেশের বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন।
বুধবার রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়ায় দেশটির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বেনারকে বলেন, “রাশিয়া বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। আমাদের সংকটময় সময়ে তারা কখনও বাংলাদেশের পক্ষে থাকেনি। বরং, তারা আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।”
“রোহিঙ্গা সংকটের সময় রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। তারা জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সেকারণে জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ায় রাশিয়া কী মনে করল সেটি আমাদের বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়,” বলেন তিনি।
আরেক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরীও মনে করেন সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে বাংলাদেশের ভোট দেয়ার ঘটনাটি সঠিক।
আলবেনিয়া প্রস্তাবিত নিন্দা প্রস্তাবটিকে ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ উল্লেখ করে তিনি বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি বাংলাদেশের এই অবস্থান ঠিক আছে।”
“বাংলাদেশে সবসময়ই দখল, আগ্রাসন, যুদ্ধের বিপক্ষে এবং অন্য রাষ্ট্রের ভৌগলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা শান্তির, আলোচনার পক্ষে। সে কারণেই ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিন ভূমি দখলের বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বরাবর ফিলিস্তিন ভূমি দখলের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে,” যোগ করেন শমসের মবিন চৌধুরী।