নারীরা কাজী হতে পারবেন না, এই রায়ের বিরুদ্ধে লড়বেন আয়েশা

শরীফ খিয়াম
2021.01.11
ঢাকা
নারীরা কাজী হতে পারবেন না, এই রায়ের বিরুদ্ধে লড়বেন আয়েশা ঝালকাঠি জেলার বারৈয়ারা গ্রামে একটি মুসলিম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছেন একজন কাজী। ১৩ নভেম্বর ২০২০।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে কোনো নারী মুসলিম বিয়ে নিবন্ধনকারী বা কাজী হতে পারবেন না বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে ছয় বছর আগে সরকারের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আইন লড়াই শুরু করেন দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকার আয়েশা সিদ্দিকা। তাঁর আইনজীবী এবং ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ফাওজিয়া করিম সোমবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন জানিয়ে ফাওজিয়া বেনারকে বলেন, “ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি আমরা।”

তিনি জানান, এখন পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুতই সুপ্রিম কোর্টে যাবেন তাঁরা।

এর আগে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছিল, চলতি সপ্তাহের শুরুতেই যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।

এতে মুসলিম নারীরা ঋতুস্রাব চলাকালে ধর্মীয় আচার পালনে অপারগতার কারণে তাঁদেরকে কাজী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে আদালত।

“সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান,” উল্লেখ করে ফাওজিয়া বলেন, “রায়ে আদালত কিন্তু কোনো আইনি কারণ দেখিয়ে এ বিষয়ক রুলটি খারিজ করেনি। তাঁরা বলেছেন, এটা সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে অগ্রহণযোগ্য।”

দেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, যারা নারীদের সমান অধিকার স্বীকার করতে চায় না তাদেরকে এই রায় উৎসাহিত করবে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বেসরকারি সংস্থা ‘নারী প্রগতি সংঘে’র নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর।

২০১৪ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার সাত, আট ও নয় নম্বর ওয়ার্ডের কাজী নিয়োগের জন্য তিন নারীর নাম প্রস্তাব আসে। ওই প্যানেলে প্রথমেই ছিল আয়েশা সিদ্দিকার নাম।

কিন্তু “বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়” মত দিয়ে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয় আইন মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তখন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন আয়েশা। এর প্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত। 

পরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রুলটি খারিজ করে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই বহাল রাখে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ। 

‘পুরুষকেই বিয়ে পড়াতে হবে, এমন শর্ত নেই ইসলামে

 “প্রাথমিকভাবে দুজন মুসলিম যুগলের মধ্যে বিয়ে পড়ানোই একজন নিকাহ নিবন্ধকের কাজ, যা মূলত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান,” মন্তব্য করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট জানায়, “শহরাঞ্চলে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান না থাকায় সম্প্রতি মসজিদে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, শারীরিক কিছু পরিস্থিতির কারণে একজন নারীর পক্ষে মাসের কোনো একটা সময় মসজিদে যাওয়া সম্ভব হয় না।”

এতে বলা হয়, “ওই সময় একজন নারী বাধ্যতামূলক দৈনন্দিন প্রার্থনা থেকেও বিরত থাকেন। শারীরিক এই অযোগ্যতা ধর্মীয় অনেক কার্যক্রম করতে তাঁকে অনুমতি দেয় না।”

তবে “কাজী কিন্তু বিয়ে পড়ান না, কোনো মাওলানা বা হুজুর পড়ান,” বলেন আইনজীবী ফাওজিয়া।

বাংলাদেশের আইনে একজন কাজী বিয়ের “নিবন্ধনকারী মাত্র” বলে মন্তব্য করেন ঢাকার তেজগাঁও রেলস্টেশন মাদ্রাসা ও জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের শাইখুল হাদিস (হাদিস বিশেষজ্ঞ) ও খতিব (খুতবা প্রদানকারী) ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ।

ইসলামি বিধানমতে কাজী “বিয়েশাদির কোনো অংশ নন,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “এখানে পুরুষ বা নারী হওয়ায় খুব বেশি ব্যবধান নেই।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের আইনে যদি অনুমোদন থাকে তাহলে কাজী হিসেবে কোনো নারীর দায়িত্ব পালন করতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।”

মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ যে কেউ মুসলিম বিয়ে পড়াতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রেও পুরুষকেই বিয়ে পড়াতে হবে, কোরআন-হাদিসে এমন কোনো শর্ত আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।”

এছাড়া ইসলামি বিধানমতে বিয়ে পড়ানোর জন্য কোনো আলেম থাকারও বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের এই উপ-পরিচালক।

তাঁর মতে মুসলিম বিয়ের জন্য দুইজন সাক্ষী এবং পাত্র-পাত্রী উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত মোহর (বিয়ে উপলক্ষে স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে দেওয়া সম্পদ) থাকাই যথেষ্ট।

“কেউ না পড়ালেও একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে যদি মোহর-সাক্ষী নির্ধারণ করে, নিজেরা একে অপরকে বলে ‘আমি তোমাকে বিয়ে করলাম’ তাতেই বিয়ে হয়ে যাবে। এজন্য আলেম বা হুজুর থাকতেই হবে এমনও কথা নেই,” বলেন মাওলানা মুশতাক। 

নারী অধিকার ‘সংকুচিত’

দেশের ২১ বিশিষ্ট নাগরিক সোমবার এক বিবৃতিতে উচ্চ আদালতকে ওই রায় পুনর্বিবেচনা করে সংবিধান প্রদত্ত নারী-পুরুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে রায় দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, নারী শরীর প্রাকৃতিক নিয়মে মাসে একবার নির্দিষ্ট সময়ে ঋতুমতী হয়, এটি প্রকৃতির নিয়মে সংঘটিত একটি জৈবিক প্রক্রিয়া।

নারীরা কাজী হতে পারবেন না বলে দেওয়া রায় “কার্যত নারী অধিকারকে সংকুচিত করেছে,” বলেও মন্তব্য করা হয় বিবৃতিতে। 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বিয়ে নিবন্ধন ধর্মীয় বিধান মেনে করা হয়ে থাকে। মুসলিম বিয়ে নিবন্ধনকারীকে ধর্মীয় পরিভাষা অনুযায়ী কাজী বলা হয়।

কাজী হিসেবে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদনকারীকে নিবন্ধিত কোনো মাদ্রাসা থেকে উচ্চমাধ্যমিক সমমানের (আলিম) সার্টিফিকেটধারী হতে হয়। ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম বিয়ে সরকার নির্ধারিত কাজী দ্বারা রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক।

একইভাবে ১৮৭২ সালের খ্রিস্টান বিবাহ আইন অনুযায়ী সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে খ্রিস্টানদের বিয়ে নিবন্ধনও বাধ্যতামূলক।

সরকার ২০১২ সালে দেশে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন প্রণয়ন করলেও বিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।