অধ্যাপক ইউনূসকে ‘কারারুদ্ধ’ করার আশঙ্কায় ১০০ নোবেল বিজয়ীর বিবৃতি
2023.08.28
ঢাকা

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম জোরে শোরে এগিয়ে চলার প্রেক্ষাপটে তিনি কারারুদ্ধ হতে পারেন এমন আশঙ্কায় তাঁকে ‘হয়রানি’ বন্ধে বিবৃতি দিয়েছেন ১০০ নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি এবং বিভিন্ন দেশের ৬০ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
সোমবার সিভিক কারেজ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটি প্রটেক্ট ইউনূস নামে একটি প্রচারণা শুরু করেছে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, শ্রমিক ঠকানোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিচারাধীন মামলার বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই।
গত রোববার দেশের ৩৪ বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে ড. ইউনূসকে ‘হয়রানি’ বন্ধের আহ্বান জানান।
এর আগে গত ১৭ আগস্ট অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে সাহস জোগাতে চিঠি লেখেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। শ্রম আইন লঙ্ঘন করার একটি মামলার বিচার কাজ শুরুর প্রেক্ষাপটে তিনি এই চিঠি লেখেন।
ড. ইউনূস চিঠিটি ছবি আকারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন।
এদিকে তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে সোমবার ১৮ সাবেক কর্মী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা দায়ের করেছেন। তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আগামী ৩১ আগস্ট ওই একই প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন লঙ্ঘন করার মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ পুনরায় শুরু হচ্ছে।
যা বলছেন বৈশ্বিক নাগরিকরা
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “...আমরা আশঙ্কা করছি যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগের মাধ্যমে ক্রমাগত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ...আমরা তাঁর সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কিত।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি না করতে মার্চ মাসেও এমন বিবৃতি দিয়েছিলেন বৈশ্বিক নাগরিকরা।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “অধ্যাপক ইউনূস কোনো অপরাধ না করে ছয় মাসের কারাদণ্ডের মুখোমুখি। যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।”
এতে আরও বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে এবং মনে হয়, আগামী নির্বাচনের আগেই ড. ইউনূসকে কারারুদ্ধ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।”
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটির কোনো আইনি সারবত্তা নেই এবং আইনি প্রক্রিয়ারও ত্রুটিপূর্ণ।”
তাঁরা বলেন, “ড. ইউনূসের বিচারকে নিয়ে বাংলাদেশে আইনের অপপ্রয়োগ চলছে এবং রাষ্ট্রকে এই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দেওয়া যায় না।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন বারাক ওবামা, ইস্ট তিমুরের রাষ্ট্রপতি জোসে রামোস-হোর্তা ও আয়ারল্যান্ডের সাবেক রাষ্ট্রপতি মেরি রবিনসন।
বিশ্বে যে সাত ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার, আমেরিকান কংগ্রেসের স্বর্ণপদক এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতির দেওয়া স্বাধীনতা মেডেল জয় করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁদের একজন। ২০১০ সালের পর থেকে সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আক্রমণ করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয় বিবৃতিতে।
সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি বলেন, “কর্তৃত্ববাদী সরকারের কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর আক্রমণই কাম্য।”
ইউনূসের বিরুদ্ধে ২০০ মামলা
আবদুল্লাহ-আল-মামুন সোমবার বেনারকে বলেন, “আজকে শ্রম আদালতে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ১৮ কর্মচারী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৮টি পৃথক মামলা দায়ের করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ কোম্পানির লাভের পাঁচ শতাংশ তাঁদের প্রদান করেনি। আদালত এ ব্যাপারে সমন জারি করে ১৬ অক্টোবরের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছে।”
ব্যারিস্টার মামুন বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী, কল-কারখানাসহ বিভিন্ন লাভজনক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লাভের শতকরা পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দিতে হবে। গ্রামীণ টেলিকম তো কল-কারখানার মধ্যে পড়ে না। এটি একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
“এই কোম্পানি গ্রামীণ নারীদের মধ্যে পল্লীফোন দিয়ে স্বাবলম্বী করতে এবং নকিয়া মোবাইল ফোন সেট বিক্রির কাজে নিয়োজিত ছিল। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং এখান থেকে কেউ লাভ গ্রহণ করতে পারে না,” যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “মামলাকারীদের এই অভিযোগের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। আমরা আইনিভাবেই বিষয়টি মোকাবিলা করব।”
“ড. ইউনূস বাংলাদেশে সমাজের উন্নয়নের জন্য সামাজিক ব্যবসা উৎসাহিত করতে ৫০টি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। উনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে ২০০ মামলা দায়ের করা হয়েছে,” জানান ব্যারিস্টার মামুন।
এগুলো হয়রানিমূলক মামলা বলেও মত দেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সোমবার বেনারকে বলেন, “ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যা চলছে সেগুলো হয়রানি ছাড়া আর কিছু না। একজন সম্মানিত মানুষকে এভাবে হয়রানি করা কোনোভাবেই উচিত নয়।”
কেন হয়রানি করা হচ্ছে মনে করেন—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দেশে একটি গুজব রয়েছে যে, সরকার পরিবর্তন হলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সরকার আসবে। হয়তো সেই বিবেচনা থেকে সরকার তাঁকে হয়রানি করছে।”
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমি মনে করি না যে, উনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হতে রাজি হবেন। তবু উনি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে।”
সরকারের অস্বীকার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সোমবার বলেছেন, “বুদ্ধি লোপ নাকি বুদ্ধি খাটিয়ে শ্রমিকদের ঠকানোর জন্য তাঁরা বিবৃতিটা দিয়েছেন—সেটিই প্রশ্ন।”
রাজধানীর পান্থপথে সামারাই কনভেনশন সেন্টারে টেলিভিশন ক্যামেরা-জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি আরও বলেন, “ড. ইউনূস সাহেবের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে চাই, কেননা তিনি একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক এবং নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেননি। তাঁর প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের দেওয়ার কথা ছিল পাঁচ শতাংশ, যা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি।”
“সেই টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে ৪০০ কোটি করা হয় এবং সেটাও তিনি দেননি। এ জন্য মামলা হয়েছে। এরপর জরিমানা হয়েছে। এখন মামলা বিচারাধীন।”