ভিন্নমতের জন্য খুন করা হয় আবরার ফাহাদকে: পুলিশ

প্রাপ্তি রহমান
2019.11.13
ঢাকা
191113_Chargesheet_abar_1000.JPG আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারের দাবিতে ঢাকায় বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ৯ অক্টোবর ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিক্ষার্থীরা ভিন্নমত সহ্য করতে পারতেন না। তাঁরা উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারও সঙ্গে মতের অমিল হলে কিংবা কারও কোনো আচরণে ক্ষুব্ধ হলেই তাঁরা মারধর করতেন।

বুধবার আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই তথ্য দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদিন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবরার হত্যা মামলায় ওই ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন তাঁরা।

এ উপলক্ষে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গত ৭ অক্টোবর ভোর রাতে আবরারকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে পিটিয়ে হত্যা করেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, শিবিরকর্মী হিসেবে সন্দেহ ছিল এ হত্যাকাণ্ডের একটি কারণ।

“তিনি (আবরার) শিবির করেন কি না, হত্যার পেছনে এটি একটি মাত্র (অন্যতম) কারণ। কিন্তু যাঁরা তাঁকে হত্যা করেছেন, তাঁরা এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে, সালাম না দিলে, তাঁদের সামনে হেসে ফেললে তাঁরা নির্যাতন করতেন,” মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন।

তিনি আরও বলেন, “নির্যাতনকারীরা চাইতেন আনুগত্য। তাঁরা মনে করছিলেন, আবরার তাঁদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছিলেন, যথাযথ আনুগত্য প্রকাশ করছিলেন না এবং তীর্যক মন্তব্য করছিলেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, আবরার ছাত্র শিবির না করলেও হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।”

বুয়েটের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিন্নমতের কারণে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন এ প্রতিষ্ঠানেরই সাবেক ছাত্র, শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত।

বেনার নিউজকে তিনি বলেন, “শুধু বুয়েট নয় দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তারা এ ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে।”

“এর কারণ আমি বলব, মূল্যবোধের অবক্ষয়। আর বুয়েটসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে অবক্ষয় চলছে তা পুরো সমাজের চিত্র। এটা ঠেকাতে হবে এবং রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতে হবে,” বলেন আইনুন নিশাত।

সম্পৃক্ত ২৫, পলাতক ৪

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশ ২৫ জনের সম্পৃক্ততা পায়। এদের মধ্যে ২‌১ জন পুলিশ হেফাজতে ও চারজন পলাতক রয়েছেন।

আবরার নিহত হওয়ার পর গত ৭ অক্টোবর তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

পুলিশ জানায় এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার হন ১৬ জন। তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে আরও যে ছয়জনের নাম জানা যায়, সেখান থেকে গ্রেপ্তার হন পাঁচজন। পলাতক চারজনকে এখনো গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আটজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

পুলিশ সাংবাদিকদের সামনে আবরার হত্যাকাণ্ডের একটি সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী আবরার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছুদিন আগে।

হত্যাকাণ্ডের রাতে আবরারকে মারধরে অংশ নেন ১১ জন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সহযোগিতা ও বাইরে থেকে এ সময় যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় আরও ১৪ জনের বিরুদ্ধে।

পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষদর্শী ও অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে যেসব ছাত্রের সম্পৃক্ততা পেয়েছে, সেসব ছাত্রকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে। এ কাজে পুলিশ ৩১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ এবং আলামত জব্দ করে।

পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, বুয়েটের ছাত্র হলের ভেতরে বিভিন্ন কারণে ছাত্র নির্যাতনের খবর পুলিশের কাছে ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কখনো এ বিষয়ে তাদের কিছু জানায়নি। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় দায় এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো অভিযোগপত্রের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেয়নি। বুয়েট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, অভিযোগপত্রের কপি হাতে পেলে প্রশাসন অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের স্থায়ী বহিষ্কারের উদ্যোগ নেবে।

প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীরা আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন বলে জানিয়েছে।

তবে আন্দোলনের সঙ্গে আছেন এমন একাধিক শিক্ষার্থী বেনার নিউজকে বলেন, তাঁরা মনে করেন অভিযুক্তরা নষ্ট রাজনীতির বলি। তাঁদেরও একজন বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলছিলেন, অভিযুক্তদের পাঁচজন তাঁর সহপাঠী। তারা প্রথম বর্ষে এমন ছিল না। রাজনীতিতে জড়িয়ে ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

এদিকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত এক আসামি অনীক সরকারের বাবা আনোয়ার হোসেন বেনার নিউজকে বলেন, তিনি আদালতে ছেলের জন্য লড়বেন।

“অভিযোগপত্রে ছেলের নাম আছে শুনেছি। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ভালো উকিল ধরব। আমার ছেলে এমন ছিল না। কী করে কী হলো বুঝি না,” আনোয়ার হোসেন বেনার নিউজকে বলেন।

উল্লেখ্য, আসামিরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক যে জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে জানান, আবরারকে সে রাতে দুই দফায় সবচেয়ে বেশি পিটিয়েছিলেন এই অনীক সরকার।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।