বুয়েট শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা
2019.10.07
ঢাকা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ মুজাহিদকে (২১) পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ।
বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝ থেকে রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে তড়িৎ প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) এই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সোমবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, “আবরারকে পিটিয়ে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে।”
বুয়েট ছাত্রলীগের দশজন নেতাকে আটক করার কথা উল্লেখ করে সন্ধ্যায় তিনি বলেন, “তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছি। সেটাও পর্যালোচনা করছি।”
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহরাব হোসেন বেনারকে বলেন, “আটককৃতদের সবাই হলেই লুকিয়ে ছিল। তাদের বিরুদ্ধে রাতের মধ্যেই মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।” নিহতের পিতাই এ মামলার বাদী হচ্ছেন বলেও সন্ধ্যায় তিনি জানান।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “সহযোগী বা অঙ্গসংগঠনের নেতাদের এমন হত্যাকাণ্ডে যুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীন দলেরই রাজনৈতিক ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।”
যা ঘটেছে শের-ই-বাংলা হলে
শের-ই-বাংলা হলের ১০১১ নম্বর রুমের বাসিন্দা আবরার গত শনিবার ভারতের সাথে সম্পাদিত তিনটি চুক্তির সমালোচনা করে ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ দিয়েছিলেন।
তাঁর সহপাঠীদের দাবি, এরই জেরে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে তাঁকে জেরার করার একপর্যায়ে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।
মূলত ‘শিবির সন্দেহে’ তাঁর ওপর চড়াও হয় তারা। এ ব্যাপারে বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু সাংবাদিকদের বলেন, “আবরারকে শিবির সন্দেহে ডেকে আনা হয়। সেখানে আমরা তাঁর মোবাইলে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার চেক করি।”
“ফেসবুকের বিতর্কিত কিছু পেইজে তাঁর ‘লাইক’ পাওয়া যায়। এ ছাড়া আমরা তাঁর শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাই। তাদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে সে। প্রমাণ পাওয়ার পরে জ্যেষ্ঠ (চতুর্থ বর্ষের) নেতাদের খবর দেওয়া হয়,” বলেন তিনি।
বিটুর দাবি, “তাঁরা আসার পর একপর্যায়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এরপর তাঁকে মারধর করা হতে পারে।”
পুলিশ জানায়, ২০১১ নম্বর রুম থেকে চারটি ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প, একটি চাপাতি, দুটি লাঠি উদ্ধার করা হয়েছে। স্ট্যাম্পগুলোর একটিতে লালচে দাগ রয়েছে, যা শুকনা রক্তের হতে পারে। এ ছাড়া সেখানে মাদক সেবনের আলামতও মিলেছে।
বুয়েটের চিকিৎসক ডা. মাসুক এলাহী গণমাধ্যমকে বলেন, “রাত তিনটার দিকে শিক্ষার্থীদের ফোন পেয়ে আমি হলে গিয়ে সিঁড়ির পাশে ছেলেটিকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। ততক্ষণে ছেলেটি মারা গেছে। তাঁর সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল।”
“আঘাতগুলো দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছে তাকে ভোঁতা কোনো কিছু দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে। এটি বাঁশও হতে পারে বা ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্পও হতে পারে,” আবরারের ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের বলেন ডা. সোহেল মাহমুদ।
“রক্তক্ষরণ ও ব্যথায় সে মারা গিয়েছে,” বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের এই বিভাগীয় প্রধান।
আবরারের সহপাঠীরা বলছে, ফেসবুকে লেখালেখি নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেও ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীরা আবরারকে মারধর করেছিল। পরে শনিবার রাতে আবরারের কম্পিউটারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যায় তারা।
কুষ্টিয়ার এনজিও কর্মী বরকত উল্লাহ ও কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষক রোকেয়া বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান আবরার। তাঁর স্বজনরা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, আবরার শিবিরের কর্মী নয়। সে উদারমনা ও প্রগতিশীল ছিল। তাঁর গোটা পরিবারই আওয়ামী লীগের সমর্থক।
ফেসবুকে যা লিখেছিল আবরার
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সই হওয়া বিভিন্ন চুক্তির প্রেক্ষাপটে শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাসে’ আবরার লিখেছিলেন;
“৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনও সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিয়েছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।”
“কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই (চায়) না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।”
“কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে, অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।”
এছাড়া স্ট্যাটাসটির শেষে তিনি কয়েক লাইন কবিতাও জুড়ে দেন।
বিভিন্ন ইস্যুতে ফেসবুকে নিয়মিত লেখালেখি করা এই শিক্ষার্থীর প্রোফাইল ছবিতেও কাশ্মীরে গণহত্যার প্রতিবাদমূলক স্লোগান লেখা রয়েছে।
প্রতিবাদ দিকে দিকে
বুয়েট ক্যাম্পাসে সোমবার দিনভর থমথমে পরিবেশ বিরাজ করেছে। চাপা ক্ষোভ থাকলেও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চায়নি শিক্ষার্থীদের। তবে সিসিটিভি ফুটেজ দেখার দাবিতে কিছু শিক্ষার্থী শের-ই-বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষের রুমের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাফর ইকবাল খান সাংবাদিকদের বলেন, “হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশকে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ছাত্রদল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন সোমবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। এ সময় হত্যার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচারের দাবি করেন বিক্ষোভকারীরা। দেশের অন্তত ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ–সমাবেশ হয়েছে।
যা বললেন ওবায়দুল কাদের
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “ভিন্নমতের জন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলা হবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে আমি পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে কথা বলেছি।”
“এখানে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যারাই দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ভিন্নমত নেই,” বলেন আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক।
আটকেরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেল, সহসভাপতি মুস্তাকিম ফুয়াদ, সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রিয়া সম্পাদক সেফায়েতুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার গ্রন্থ ও গবেষণা সম্পাদক ইশতিয়াক মুন্না এবং ছাত্রলীগ কর্মী তাবাখখারুল ইসলাম তানভির।
সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই তাদের আটক করা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন।
সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ভারতের সঙ্গে আওয়ামী সরকারের দেশবিরোধী চুক্তির প্রতিবাদ করায় আবরারকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।”
সর্বশেষ
রাত ১০ টার দিকে বুয়েট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাযার পর আবরারের মরদেহ নিয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয় তার স্বজনরা।
এর আগে দাবির মুখে হলেল সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এটি যাচাই-বাছাই করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের কথা উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থীকে হলের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে ১৯ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করে আবরারের বাবা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাংবাদিকদের বলেন, “আর কোনও মেধাবী ছাত্রের যেন এভাবে মৃত্যু না ঘটে।”
ফাহাদকে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা অভিযোগে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১১ নেতাকে সোমবার রাতেই স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাতে এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে’ এ ঘটনায় থানায় একটি জিডি এবং একটি তদন্ত কমিটি করার কথা জানায়।
বুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সংগঠিত অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনার বিষয়ে সোমবার সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, বিভাগীয় প্রধান, পরিচালক, প্রভোস্ট, রেজিস্টার ও সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।” ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদন্ত কাজে সহযোগিতা করারও অনুরোধ জানানো হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।