নির্বাচনী অনিয়মের ‘স্বচ্ছ’ তদন্ত চায় পশ্চিমা দেশগুলো
2019.01.02
ঢাকা

বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে ওঠা অভিযোগগুলো ‘স্বচ্ছ’ তদন্ত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার বেনার নিউজের পক্ষ থেকে করা প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, “নির্বাচনকালীন যে সমস্ত ছোটখাটো সহিংসতা হয়েছে তা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।”
“এ বিষয়ে ইতিমধ্যে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। পুলিশের কাছে ঘটনার একটা প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।”
এ ছাড়া অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আসনগুলো থেকে অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন ইসি সচিব।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটারের উপস্থিতি এবং দীর্ঘ বিরতির পরে সকল দলের অংশগ্রহণকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও ভোটে যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তার ‘স্বচ্ছ’ তদন্ত চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এবং ইইউ। মঙ্গলবার পৃথক পৃথক বিবৃতিতে এ আহবান জানায় তারা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারত, চীন, সৌদি আরব, কাতার ও শ্রীলঙ্কার নেতারা। মঙ্গলবার পৃথক বার্তায় এ অভিনন্দন জানায় তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর এ ধরনের বিবৃতি দেওয়া কাম্য নয়। যদিও নির্বাচনের অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এ ধরনের অবজারভেশন বা বক্তব্য দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর হঠকারিতা। এর কোনো প্রভাব যদিও সম্পর্কের ক্ষেত্রে পড়বে না।”
“একটা দেশের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে বাইরে থেকে কথা বলার সুযোগ খুব কম। কারণ আমরা জানি বিশ্বের সব দেশ কিন্তু রাজনৈতিকভাবে একই অবস্থানে নেই,” বলেন তিনি।
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো খতিয়ে দেখা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। আমাদের আদালতের সুস্পষ্ট রায় আছে, যদি কোনো অভিযোগ ওঠে তাহলে সেগুলো তদন্ত করে প্রয়োজনে ফলাফল বাতিলও করতে পারে নির্বাচন কমিশন।”
বিবৃতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সকল পক্ষকে নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রত্যাশা রেখে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে এ দেশের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে ইইউ।
আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিবেচনা করে পারস্পরিক মতবিরোধ অবসানে রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে যুক্তরাজ্য।
গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়। ভোটের আগের রাত থেকে এ দিন পর্যন্ত সব মিলিয়ে দেশের ১২টি জেলায় সহিংসতায় ১৭ জন নিহত হন। এর বাইরে আরও অন্তত নয়টি জেলায় সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০৪ জন আহত হয়।
এই নির্বাচনে ভোট হওয়া ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনের জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতা নিশ্চিত করল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এর মধ্যে ২৫৭টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ ও ২২টি পেয়েছে জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলীয় জোট বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে মাত্র ৭টি আসন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানালেও ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবি তুলেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ দল বর্জনের করায় সেবার অসন্তোষের কথা জানিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর নির্বাচনের আগে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতার অভিযোগ ওঠার বিষয়টি তুলে ধরে বিবৃতিতে বিরোধী জোটের অনেক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের প্রচার বিঘ্নিত হয় বলে জানায়।
অনিয়মের কারণে অনেকে ভোট দিতে পারেননি এমন অভিযোগের খবরে উদ্বেগ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়। নির্বাচনের পর এখন সহিংসতা এড়ানোর পাশাপাশি, সব পক্ষকে নিয়ে গঠনমূলকভাবে অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করতে ইসির প্রতি আহবান জানায় দেশটি।
ব্রাসেলস থেকে ইইউয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়, গত ১০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ও বিরোধীদের অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আকুল আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
ইইউ জানায়, নির্বাচনের দিন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো বাধা থেকেই যায়, যা নির্বাচনী প্রচার ও ভোটকে কলঙ্কিত করেছে।
এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে এসব অনিয়মের অভিযোগ যথাযথভাবে খতিয়ে দেখার কাজটি নিশ্চিত করতে হবে।
একই ধরনের অভিযোগ এনে বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেন, “এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত, দেশের জনগণের স্বার্থে একসঙ্গে বসে নিজেদের বিরোধগুলো মিটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ বের করা।”
মহাজোটের শপথ বৃহস্পতিবার, অনিশ্চিত ঐক্যফ্রন্ট
আগামীকাল বৃহস্পতিবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মহাজোটের নবনির্বাচিত সংসদ-সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন বলে বেনারকে জানিয়েছে সংসদ সচিবালয় সূত্র। এর আগে মঙ্গলবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন বেনারকে বলেন, “প্রথমে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ-সদস্য, এরপর জাতীয় পার্টি এবং পরে অন্যান্য সদস্যরা শপথ গ্রহণ করবেন।”
শপথ গ্রহণ শেষে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্যরা একাদশ সংসদের নেতা নির্বাচন করবেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন বরিশাল-১ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ-সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ।
সংবিধান অনুযায়ী, এর পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী নেতাকে সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন রাষ্ট্রপতি। তিনি সরকার গঠন করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন।
এদিকে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা বিরোধীজোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংসদে যোগ দেবে কি না সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
বৃহম্পতিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনে গিয়ে লিখিতভাবে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানাবে বলেন বেনারকে জানান ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামালের দল গণ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী।
তিনি বলেন, “শপথ গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে দুটি মত আছে। একটি মত হলো, ফলাফল যা হয়েছে তা মেনে নিয়ে আমাদের যে সাতজন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা সংসদকে ব্যবহার করে রাজনীতি চাঙ্গা করবেন।”
“আর আরেক মত হলো, সংসদে গেলে আমরা ফলাফল মেনে নিলাম,” তিনি বলেন।
সুব্রত চৌধুরী বলেন, “আমরা দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব সংসদে যাব কি না।”
সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সংসদ-সদস্য যদি সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ না করেন সেক্ষেত্রে তার সংসদ-সদস্যপদ বাতিল ও আসন শূন্য ঘোষিত হবে।