সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম: ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানি
2019.02.22
ঢাকা

দেশে ৩০ ডিসেম্বর কোনো নির্বাচনই হয়নি বলে দাবি করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে শুক্রবার অনুষ্ঠিত এক গণশুনানিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম তুলে ধরে তাঁরা এমনটা বলেছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ সরকার বিরোধী এ জোটের প্রতিটি দলের প্রার্থীর অভিমত, “মানুষকে ওই দিন ভোটই দিতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ-প্রশাসন ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সারা দেশে ব্যালটে সিল দিয়ে বাকশো ভর্তি করেছিল।”
শুনানিতে অংশ নেওয়া কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও জোটের প্রার্থী ফজলুর রহমান বেনারকে বলেন “বিএনপির কোনো এজেন্ট ভোট কেন্দ্রে গেলে তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হবে বলেও পুলিশ হুমকি দিয়েছিল।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “নির্বাচনে হেরে গিয়ে তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এ কারণে তারা অবান্তর এবং অগ্রহণযোগ্য সব অভিযোগ উত্থাপন করছে।”
তবে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুড়ি সিদ্দিকীও শুনানিতে বলেন, “আমার নির্বাচনী এলাকায় সব কটা ভোট কেন্দ্রে ‘পোলিং এজেন্টদের’ বের করে দেওয়া হয়েছিল।”
“কেন্দ্র বন্ধ করে ভোটের বাকশে ব্যালট ভর্তি করা হয়,” যোগ করেন তিনি।
পাবনা-৪ আসনের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, “আমার অধিকাংশ এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে।” এর আগে ২৬ ডিসেম্বর হাবিবকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হয়।
মূল বিচার ট্রাইব্যুনালে
সাত সদস্যের বিচারক প্যানেলের প্রধান হিসেবে উদ্বোধনী বক্তব্যে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, “বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নাই। মূল বিচার হবে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে।”
“এই গণশুনানি জনগণের জন্য। যাতে তারা নিজ বিবেচনায় পরিস্থিতি বিচার করতে পারেন। নির্বাচনে কী ঘটেছিল, প্রার্থীদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা তাদের জানানো উচিত,” যোগ করেন প্রথিতযশা এই আইনজীবী।
হাইকোর্টের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ৭৪ টি মামলা দায়ের করেছেন ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, “নির্বাচনে পরাজিতরা ট্রাইব্যুনালে তাঁদের অভিযোগ পেশ করেন, এটা নতুন কিছু নয়।”
এদিকে গণশুনানির বিচারক প্যানেলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক বিচারপতি একেএম আনিসুর রহমান খান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নুরুল আমিন বেপারী ও দিলারা চৌধুরী।
আরও ছিলেন আইনজীবী ড. মহসিন রশীদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সংসদ নির্বাচনের পর এটাই ছিল ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় আয়োজন।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৯টিতে জয়লাভ করে। আর বিএনপিকে সাথে নিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন।
বন্দী ছিলেন প্রার্থীরা
শুনানিতে নির্বাচনের আগের ও পরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে, আবার কাউকে নিজ বাড়িতেই গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।
কিশোরগঞ্জের ফজলুর বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে আমাকে এলাকায় যেতে দেওয়া হয়নি। ভোটের সময় প্রবেশ করতে গেলেও পুলিশ বাধা দিয়েছিল, যা উপেক্ষা করেই আমি এলাকায় গিয়েছি।”
“ডিসেম্বরের ১১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত গণসংযোগ করতে পেরেছি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আমার সঙ্গে ছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ‘অ্যাকশনে’ নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।”
ফজলুরের দাবি, তখন বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। তাঁর এলাকায় এক একটি অভিযানে আট থেকে নয়শ পুলিশ অংশ নিয়েছিল।
“অথচ অত পরিমাণ পুলিশ থানায় কিংবা ব্যারাকে ছিল না,” উল্লেখ করে ফজলুর বলেন, “পুলিশের পোশাক পরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরাও সেসব অভিযানে অংশ নিয়েছিল।”
শুনানিতে হবিগঞ্জ-২ আসনের প্রার্থী গণফোরামের ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, “নির্বাচনের সময় আমার বাড়িতে মিটিং শেষে নেতারা বের হওয়া মাত্র সাদা পোশাকধারী লোকেরা তাদের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।”
“আমার এলাকার নেতারা নির্বাচনের এক মাস পূর্বেই পলাতক থাকতে বাধ্য হয়েছেন,” যোগ করেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়ার এই সন্তান।
কীভাবে শতভাগ ভোট?
“আমার আসনের সাতটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে,” উল্লেখ করে লালমনিরহাট-৩ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী আসাদুল হাবিব দুলু শুনানিতে প্রশ্ন তোলেন, “যেসব কেন্দ্রে ভোটার যায়নি, সেখানে কীভাবে শতভাগ ভোট পড়ে?”
পাবনার হাবিব বলেন, “আমাকে জেলার এসপি ও ডিসি সাহেব বললেন, আপনার আসনে সিল মারা হবে। আমি বললাম কত পারসেন্ট? তারা বললেন, ৩৫ পারসেন্ট। আমি বললাম সমস্যা নেই, তবু আমি জয়ী হব।”
“কিন্তু রাতে যখন সিল মারা শুরু হলো, আমি প্রিসাইডিং অফিসারকে জানালাম। তিনি দাবি করলেন- না, হচ্ছে না,” বলেন তিনি।
শুনানিতে যাননি যারা
গণশুনানিতে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো এতে অংশ নেয়নি।
এ বিষয়ে জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বেনারকে বলেন, “আমি শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারিনি। অন্যরা কেন যায়নি তা বলতে পারব না।”
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বড় একটি অংশও শুনানিতে অনুপস্থিত ছিলেন।
আমন্ত্রণ পায়নি জামায়াত
জোটে থাকলেও জামায়াতে ইসলামীকে শুনানিতে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তিনি বলেন, “জামায়াত কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাদের যেসব নেতা ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছিল তারা ছিল বিএনপির প্রার্থী।”
আলাদা অবস্থানে বামপন্থীরা
কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী দলগুলোর সবাইকে শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ হয়েছিল বলে জানান ডা. জাফরুল্লাহ। তবে বাম সংগঠনগুলোর কাউকেও সেখানে দেখা যায়নি।
এ ব্যাপারে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বেনারকে বলেন, “নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে—এ নিয়ে আমাদের ভিন্নমত নেই। তবে আমরা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন উভয় জোট থেকে আলাদা অবস্থানে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই।”