আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভোটের পরিবেশ নেই
2018.12.04
ঢাকা

দেশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ তুলেছে পাহাড়িদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
আগামী ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আঞ্চলিক দল দুটির এমন অভিযোগ। দল দুটির নেতাদের দাবি, পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল ‘স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কার্যক্রম’ চালাতে পারছে না। নির্বাচন সামনে রেখে তাদের নেতা–কর্মীদের তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের নামে দমন-পীড়ন করছে স্থানীয় প্রশাসন।
তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) যুগ্ম-সচিব (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান আরজু বেনারকে বলেন, “কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা (জেএসএস ও ইউপিডিএফ) হয়তো এমনটা মনে করছে। কমিশন অবশ্যই তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে।”
“নির্বাচনী পরিবেশ নেই তা দাবি করলেই মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সব আসনের সামগ্রিক পরিস্থিতি আমরা (ইসি) সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছি,” বলেন তিনি।
রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার মো: আলমগীর কবির বেনারকে বলেন, “তাদের এই অভিযোগ ঠিক নয়, ভিত্তিহীন।”
তবে নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য পুরো পার্বত্য এলাকা জুড়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
“চেকপোস্টের সংখ্যা বাড়ানো হলেও কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না,” তাঁর দাবি।
দুই দশকের বেশি সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রের সাথে ‘শান্তি চুক্তি’ করা জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, “আসন্ন নির্বাচনে কার্যত ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে সহায়তা করার হীন উদ্দেশ্যে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে।”
ঢাকায় বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, “বিরাজমান পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।”
অন্যদিকে পার্বত্য এলাকায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে আত্মপ্রকাশকারী ইউপিডিএফ এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি দল ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কার্যক্রম চালাতে দেয়া হচ্ছে না। এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।”
ইউপিডিএফ’কে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ‘ষড়যন্ত্র’ জারি রয়েছে উল্লেখ করে গত ৯ নভেম্বরের ওই বিবৃতিতে খীসা আরও বলেন, “ইউপিডিএফ, জেএসএস ও তাদের সহযোগী সংগঠনের ওপর দীর্ঘ দিন ধরে নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন জারি রয়েছে। তাদের শত শত নেতা-কর্মী ও সমর্থককে মিথ্যা ও সাজানো মামলায় জড়িয়ে কারাগারে অন্তরীণ বা এলাকাছাড়া করা হয়েছে।”
সর্বশেষ রবিবার খাগড়াছড়ি আসনের ইউপিডিএফ সমর্থিত দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সংগঠক ও মুখপাত্র মাইকেল চাকমার দাবি, “রাজনৈতিক কারণে এমনটা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি চলছে।”
এর আগে গত সপ্তাহে ইউপিডিএফ এর ওই প্রার্থীদের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ফেরার পথে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অমল ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেত্রী অ্যান্টি চাকমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
“তাদেরও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক হামলায় ফাঁসানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার জামিনের আবেদন বাতিল করে দুজনকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত,” বেনারকে বলেন মাইকেল।
অন্যদিকে সন্তু লারমার দাবি, “জেএসএসের সদস্যদের বিরুদ্ধেও একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করছে এবং গ্রেপ্তার ও আটক করে নির্যাতন চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্ম জাতি-গোষ্ঠীমুক্ত করতে চাচ্ছে।”
তবে এসপি আলমগীর বেনারকে বলেন, “পার্বত্য এলাকায় গত এক বছরে অনেকগুলো খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধ ঘটেছে। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার সন্দেহভাজন ছাড়া কেউকে গ্রেপ্তার হচ্ছে না।”
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিক আজাদি ৩ নভেম্বর এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত ১২ মাসে পাহাড়ে সংঘাতে মারা গেছেন ৪০ জন। নিহত প্রায় সকলেই আঞ্চলিক রাজনৈতিক ইউপিডিএফ, জেএসএস বা সংগঠন দুটির সংস্কারপন্থী গ্রুপ ‘ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক’ ও ‘জেএসএস-এমএন লারমা’ গ্রুপের নেতাকর্মী।
দুই সংগঠনের সংস্কারপন্থী গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত ‘নব্য মুখোশ বাহিনী’-কে পাহাড়ের সাম্প্রতিক অরাজকতার জন্য দায়ী করেছেন মূলধারার নেতারা। সংস্কারপন্থীরা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘মদদপুষ্ট’ বলেও দাবি করা হচ্ছে। তবে এর সত্যতা নেই বলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
যদিও এসপি আলমগীর মনে করেন, “দুর্গম পার্বত্য এলাকায় নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রাখা নিঃসন্দেহে অনেক ‘চ্যালেঞ্জিং’।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, আঞ্চলিক রাজনীতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে পার্বত্য অঞ্চলে নির্বাচনী অরাজকতার ঝুঁকিও দেশের যেকোনো এলাকার চেয়ে বেশি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী বেনারকে বলেন, “ইসি চাইলে পার্বত্য তিন সিটের নির্বাচন স্থগিতও রাখতে পারে। এতে সামগ্রিক ফলাফলে, অর্থাৎ সরকার গঠনের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।”
“পরিস্থিতি অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন ইসির যুগ্ম-সচিব আরজু।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেএসএস-ইউপিডিএফ
এবার বান্দরবানে আঞ্চলিক দলগুলোর কোনো প্রার্থী নেই। রাঙ্গামাটি আসনে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বর্তমান সাংসদ উষাতন তালুকদার ও সংগঠনের জেলা শাখার নেতা শরৎ জ্যোতি চাকমা।
এই আসনে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী শান্তি দেব চাকমা ও সচিব চাকমা।
ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় নেতা সচিব খাগড়াছড়িতেও মনোনয়নপত্র জমা দেন। তাদের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন নতুন কুমার চাকমা নামের আরও এক স্থানীয় নেতা। এই আসনে জেএসএস কোনো প্রার্থী দেয়নি।
জেএসএস মুখপাত্র দীপায়ন খীসা বেনারকে বলেন, “আমাদের মনে হয়, পরিবেশ না থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে।”
আর ইউপিডিএফ মুখপাত্র মাইকেল বলেন, “আমরা আশা করছি, ইসি সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।”
শান্তি চুক্তির ২১ বছর পূর্তিতে ক্ষোভ
পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাত অবসানকারী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের শান্তি চুক্তির ২১ বছর পূর্তি উপলক্ষে রবিবার এক আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং বলেন, “শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ এবং ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। এ ছাড়া নয়টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”
তবে জেএসএস বলছে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ আওয়ামী লীগ টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ অবাস্তবায়িত থাকা হতাশাজনক।
চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে না গিয়ে সরকার জম্মু জাতিগোষ্ঠী এবং শান্তি চুক্তির বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, “সমস্যা এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।”
তাঁর অভিযোগ, “শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত ২০টি সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১১টি হামলা হয়েছে বর্তমান সরকার আমলে।”