নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশিদের সাড়া কম

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.12.05
ঢাকা
181205_Election_observer_1000.jpg বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়ন আবেদন বাতিলের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে আপিল করার পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন তাঁর আইনজীবী কাওসার কামাল। ৫ ডিসেম্বর ২০১৮।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনকে আহ্বান জানানো হলেও এখন পর্যন্ত খুব বেশি সাড়া মেলেনি।

নির্বাচন কমিশন একাদশ সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কমনওয়েলথ, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলোর সংগঠন ফেমবোসাসহ বিভিন্ন সরকার ও সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহ দেখায়নি।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, এ বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে কমিশনকে জানিয়ে দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ শাখার প্রধান এসএম আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, কমনওয়েলথ, ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত সংস্থা ফেমবোসা ও আরও কিছু সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।”

তিনি বলেন, “এখনো এব্যাপারে কমনওয়েলথ, ফেমবোসা ও অন্যান্য সংস্থা আমাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। আশা করা যায়, তারা আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে, পর্যবেক্ষক পাঠাবে।”

আসাদুজ্জামান বলেন, “সোমবার আমেরিকান দূতাবাসের পক্ষ থেকে প্রায় ৬৫ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, পর্যবেক্ষক, দোভাষী, নিরাপত্তা দলের সদস্য।”

তিনি জানান, এ ছাড়া, জাপান, জার্মানি, স্পেন ও অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

“তবে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক হবেন বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশি। এবার বিদেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা হবে কম,” যোগ করেন আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, নেপালি প্রতিষ্ঠান ডিপেন্দ্র কানডেল ইনিশিয়েটিভের (ডিকেআই) পক্ষ থেকে তিনজন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আগ্রহ প্রকাশ করে অবেদন করেছেন।

আসাদুজ্জামান জানান, বিদেশি পর্যবেক্ষক ছাড়াও বাংলাদেশি ১১৮টি বেসরকারি সংস্থার প্রায় ৩৫ হাজার নির্বাচন পর্যবেক্ষক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন।

এদিকে নির্বাচন কমিশনের সাথে সভা করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে বলে জানান তিনি।

ইইউর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা পর্যবেক্ষকের পরিবর্তে দুজন এক্সপার্ট পাঠিয়েছে, যারা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

গত ২৮ নভেম্বর ইইউর একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক করে।

বৈঠক শেষে ইইউ থেকে আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক আসছেন না বলে সাংবাদিকদের জানান প্রতিনিধিদলের প্রধান রেন্সজে তেরিংক।

“একটি সম্পূর্ণ টিম পাঠানো সময়ের ব্যাপার। সে জন্য পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ রাখতে পারছি না,” বলেন রেন্সজে তেরিংক।

তিনি বলেন, “এখানে ১০ কোটি ৪০ লাখ ভোটার ও ৪০ হাজার কেন্দ্র রয়েছে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ইইউ-এর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশে একটি বিশেষজ্ঞ টিম এসেছে। তারা এখানে ১৪ দিন থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। তবে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর বিষয়টি হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত।”

‘পর্যবেক্ষকরা মূর্তির মতো থাকবেন’

গত ২০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিদের ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষকরা ‘শুধু মূর্তির মতো’ দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন।

তিনি বলেন, “নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষকেরা কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। কেবল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন। কেন্দ্রে যত সমস্যা হোক, তিনি কেবল পর্যবেক্ষণ করবেন, পর্যবেক্ষণ শেষে প্রতিবেদন দেবেন।”

হেলালুদ্দীন বলেন, পর্যবেক্ষণের সময় গোপন কক্ষে যাওয়া যাবে না। কাউকে নির্দেশনাও দেওয়া যাবে না। তবে কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম হলে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে পারবেন।

পর্যবেক্ষরা মোবাইল ফোন নিয়েও যেতে পারবেন না বলে জানান সচিব।

পর্যবেক্ষণের জন্য এনডিআই’র চিঠি

ডিসেম্বর ৪ তারিখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে পাঠানো চিঠিতে মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউটের (এনডিআই) প্রেসিডেন্ট ডেরেক মিচেল জানিয়েছেন তাঁরা ২৬ টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ‘এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (আনফ্রেল) এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী।

বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আনফ্রেলকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে এনডিআই। এনডিআই’র ওই চিঠির একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে।

আনফ্রেল স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে বলে জানানো হয়েছে চিঠিতে।

১৯৯৭ সালে গঠিত আনফ্রেলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে এশিয়ার ১৬টি দেশের বিভিন্ন সংগঠন। তারা এশিয়ার ১৬ দেশে ৫৮টি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে।

চিঠিতে এনডিআই প্রেসিডেন্ট বলেন, আনফ্রেলের দুজন আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক, ১৪ জন দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষক ও ১৬ স্বল্পমেয়াদি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের ভিসার অপেক্ষায় রয়েছেন।

তাঁদের দ্রুত ভিসা প্রদানের ব্যবস্থা করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

আসাদুজ্জামান বলেন নির্বাচন কমিশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এনডিআই’র চিঠি পেয়েছে।

তিনি বলেন, সোমবার এনডিআই প্রতিনিধিদলের সাথে সভা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা।

আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমরা আনফ্রেলসহ অন্যান্য যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চায় তাদের নামের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থায় পাঠাব। তারা ক্লিয়ারেন্স দিলে পর্যবেক্ষকরা আসতে পারবেন। তবে আমরা চাই বেশি বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করুক।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধভাবে অনুষ্ঠান করতে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকলে যারা নির্বাচনে অনিয়ম করতে চায় তারা ভয়ে থাকে যে তাদের অনিয়ম বিদেশে প্রচারিত হবে। নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করা একটি বড় ঘাটতি।

ড. নিজাম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের উচিৎ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আকৃষ্ট করতে ব্যবস্থা নেয়া।

বিরোধী জোটের সবচে বড় দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের উচিৎ এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া যার মাধ্যমে বিরোধী দলের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব এমন আস্থা সৃষ্টি হয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।