‘সকল পক্ষের সমান সুযোগ’ নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনেই বিরোধ

শরীফ খিয়াম
2018.12.19
ঢাকা
181219_EC_story-December_1000.jpg ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের মাঠে সকল পক্ষের সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যেই ক্রমশ মতবিরোধ বাড়ছে।

এই ইস্যুতে গত কয়েকদিন ধরে প্রকাশ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা এবং নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

নূরুল হুদার দাবি, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে’। আর মাহবুব তালুকদার বলছেন, ‘নেই’। সর্বশেষ বুধবার সিইসির বিরুদ্ধে তিনি ‘অস্তিত্বে আঘাত’ করার অভিযোগ তুলেছেন।

নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “কমিশনারদের মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে এবং তাঁদের মতবিরোধ যদি এভাবে প্রকাশ্যে আসে; তবে জনমনে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়।”

“কমিশনারদের মধ্যে ‘মতভেদ’ থাকতে পারে। তবে এ নিয়ে ‘বাদানুবাদ’ না হওয়াই ভালো। এই ঝগড়াঝাঁটি বা কাদা ছোড়াছুড়ি সংযতভাবে দূর করা উচিত। নয়ত পরিস্থিতি ঘোলাটেই থেকে যাবে,” যোগ করেন এই অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী বলেন, “সাধারণত সরকার বা বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু এবার তাঁরা নিজেরা যেভাবে মতবিরোধে জড়িয়েছেন, এটা একদিক থেকে ভালো। এর ফলে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।”

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বুধবার সাংবাদিকদের নিজ কক্ষে ডেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মাহবুব বলেন, “ইতিপূর্বে সিইসি মহোদয় আমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানারূপ বিরূপ উক্তি করেছেন। আমি কখনো তাঁর কথার প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই’ বলে আমি মিথ্যা বলেছি, এ কথার প্রতিবাদ না করে পারলাম না।”

এর আগে সোমবার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি মনে করি না নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটা এখন অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে।”

পরদিন মঙ্গলবার রাঙামাটিতে এক অনুষ্ঠানে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, “নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে। মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য ব্যক্তিগত ও অসত্য।”

এরই প্রেক্ষিতে মাহবুব তালুকদার বলেন, “আমি তাঁর এই বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ, এ কথা বলে তিনি একজন নির্বাচন কমিশনারের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন।”

এর আগে সোমবার তিনি আরো বলেছিলেন, “আমি কখনোই তাঁর (সিইসি) বক্তব্যের বিরোধিতা করি না। তিনি তাঁর কথা বলেন। আমি প্রয়োজনে আমার ভিন্নমত প্রকাশ করি।”

“তাঁদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে যা দেখছি, দুজন দুই মেরুতে চলে গেছেন। যে যার বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এর কোনটি ঠিক, আর কোনটা বেঠিক এটাও জনগণ ছাড়া কেউ বিচার করতে পারবে না,” বেনারকে বলছিলেন এম সাখাওয়াত।

তাঁর মতে, “ইসি সবচেয়ে স্পর্শকাতর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে কমিশনারদের মধ্যে যদি একতা না থাকে, তবে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব পালন প্রায় অসম্ভব।”

এম সাখাওয়াত বলেন, “সিইসিসহ সব কমিশনার সমান হলেও সমঝোতার মাধ্যমে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার দায়িত্ব কিন্তু সিইসির। তবে বাংলাদেশে খুব কম নির্বাচন কমিশন ‘টিম’ হিসেবে কাজ করেছে। সব কমিশনের মধ্যেই গণ্ডগোল ছিল।”

বিতর্কের শুরু যেভাবে

আগামী ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল ভোটের মাঠে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত হচ্ছে না। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পরও দফায় দফায় অভিযোগ দিয়ে একই কথা বলে আসছে তারা।

এর মধ্যেই গত শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়েছে।”

পরবর্তীতে সোমবার বিকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এক প্রতিনিধি দল ইসির সঙ্গে বৈঠক করে পুনরায় একই অভিযোগ জানানোর পর মাহবুব তালুকদার মুখ খোলেন।

এ ব্যাপারে বুধবার মাহবুব তালুকদার বলেন, “সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমি বলেছিলাম, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কি নেই তা সাংবাদিকেরা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর পেয়ে যাবেন।”

“এখনো সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলছি, আপনারা নিজেরা বিচার বিবেচনা করে দেখুন, নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কি নেই?” যোগ করেন তিনি।

এর আগে নির্বাচনে ‘ইভিএম’ ব্যবহারের বিরোধিতা করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে সভা বর্জনও করেছিলেন এই নির্বাচন কমিশনার।

যে কারণে এই বিভেদ

এম সাখাওয়াত বলেন, “গণমাধ্যমে যে ধরনের চিত্র ফুটে উঠেছে, প্রার্থীদের ওপর হামলা-পাল্টা হামলা, গুলি ছোড়াছুড়ি, এমন চিত্র কিন্তু বিগত পাঁচ-ছয়টি জাতীয় নির্বাচনের আগে দেখা যায়নি। এ কারণেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে এক কথা হচ্ছে।”

“সিইসি বললে হবে না; ভোটার, প্রার্থী আর পর্যবেক্ষকরাই ভালো বলতে পারবেন যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হয়েছে কিনা,” যোগ করেন বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণাকারী এই সাবেক কমিশনার।

যদিও ড. অরুণ বেনারকে বলেন, “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বললেও বিএনপি এবং তাদের নিয়ে গঠিত নির্বাচনী মোর্চা ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা কিন্তু ‘ফিল্ডে’ চলে গিয়েছে। প্রচারণায় সব পক্ষই সক্রিয় আছে। সারা দেশই এখন নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত।”

তিনি মনে করেন, “প্রধান বিরোধ দল বিএনপির মধ্যে যে অংশটি নির্বাচন বর্জনের পক্ষে ছিল, তারা এখনো নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাইছে। মাহবুব তালুকদার তাদের মতো করেই কথা বলছেন।”

এম সাখাওয়াত বলেন, “এখানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে যেভাবে কমিশনার নিয়োগ হয়, সেই প্রক্রিয়াতেই গলদ আছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।