হাতে গোণা বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন নির্বাচনে
2018.12.26
ঢাকা

আগামী রোববার অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে গত ১০ বছরের মধ্যে সকল দলের অংশগ্রহণে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। তবে এই নির্বাচনেই গত ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকবেন বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার নির্বাচন পর্যবেক্ষক যাদের মধ্যে বিদেশি মাত্র ১৭৬ জন।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ও যুগ্ম সচিব এসএম আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ১৮ দেশ ও প্রতিষ্ঠানের মোট ১৭৬ জন বিদেশি পর্যবেক্ষককে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন পর্যবেক্ষক গ্রুপ অ্যানফ্রেল পর্যবেক্ষকদল পাঠাচ্ছে না বলে জানিয়েছে। তবে ওআইসির একটি পর্যবেক্ষকদল দেশে আসতে পারে।”
ব্যাংকক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (অ্যানফ্রেল) তাদের ৩২ জন পর্যবেক্ষককে পাঠাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তাদের অভিযোগ তাদের পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন করতে দেরি করেছে নির্বাচন কমিশন ও তাদের ভিসা প্রক্রিয়া বিলম্বিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যানফ্রেলের সিদ্ধান্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছে।
নির্বাচন কমিশনের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার পর্যবেক্ষক। এদের মধ্যে বিদেশি ছিলেন ৫৯৩ জন।
২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন দুই লাখ ১৯ হাজার যাদের মধ্যে ২২৫ জন বিদেশি।
নির্বাচন কমিশনের বিদেশি পর্যবেক্ষকদের তালিকা বেনারনিউজের কাছে রয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী, আমেরিকান দূতাবাস সর্বোচ্চ ৬৫ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করছে।
এছাড়াও অন্যান্য যেসব দূতাবাসের পক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ নয় জন করে পর্যবেক্ষ আসবেন তার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, জাপান, স্পেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নেপাল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইইউ, সুইজারল্যান্ড ও কানাডা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “গত ১৭-১৮ বছরের মধ্যে এবার সর্বনিম্ন সংখ্যক নির্বাচন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষক, বিশেষ করে বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বিরাট ভূমিকা রাখেন।”
তিনি বলেন, “যারা কারচুপি করতে চায় তারা পর্যবেক্ষকদের দেখলে কারচুপি করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে। তারা মনে করে, ওই কেন্দ্রের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক মন্তব্য পুরো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “নির্বাচনে যত বেশি পর্যবেক্ষক থাকবে নির্বাচনের জবাবদিহি তত বেশি নিশ্চিত হবে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সব সময়ই বলছে, তারা একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। আর নির্বাচন কেমন হয়েছে সেই কথাগুলো দেশের মানুষ জানতে চায় পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে। বিএনপির পক্ষ থেকে বেশি করে পর্যবেক্ষক প্রেরণের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, নির্বাচন কমিশনের উচিৎ বেশি সংখ্যক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।”
তিনি বলেন, তবে কোনো বিতর্কিত ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে এমন সংগঠনকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়া উচিত নয়।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক গ্রুপ সম্পর্কে আপত্তি
আসাদুজ্জামান বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কমিশন ৮১টি স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাকে নিবন্ধিত করছে। তিনি বলেন, ওই ৮১টি সংগঠনের ২৫ হাজার ৯২০জন পর্যবেক্ষককে অনুমতি দেয়া হয়।
এদের মধ্যে ২২টি সংগঠন ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ব্যানারে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল বুধবার বেনারকে বলেন, নির্বাচন কমিশন তাদের ১৫ হাজার পর্যবেক্ষককে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়।
তিনি বলেন, তবে বিদেশি অর্থ ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণের জন্য ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ২২টি সংগঠনের মধ্যে ১৫টি সংগঠনকে অনুমতি দেয়নি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের আওতাধীন এনজিও বিষয়ক সংস্থা। আর সাত সংগঠনকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ওই সাত সংগঠনগুলো হলো: জানিপপ, সলিডারিটি, এসইডি, উত্তরণ, আইইডি, গাক এবং বাঁচতে শেখা।
আওয়াল বলেন, “আমাদের পরিকল্পনা ছিল ১৫ হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা। কিন্তু এনজিও বিষয়ক সংস্থার কাছে দাতাদের কাছ থেকে অর্থ ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া সাত সংগঠন ৫,৭০০ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে। আর বাকি ১৫ সংগঠন নিজেদের অর্থ ব্যবহার করে নিয়োগ করবে বড়জোর আরও আট’শ।”
তিনি বলেন, “সব মিলিয়ে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৫ হাজারের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৬,৫০০ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে পারবে।”
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ ইউএসআইডি, ইউকে এবং নরওয়ে দূতাবাস থেকে অর্থ পেয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ বাদে আরো ৫৯ স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন মিলে ১০ হাজার ৯২০ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে।
সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৭ হাজার নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবছর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ার এইচটি ইমাম শুক্রবার নির্বাচন কমিশনে এসে বিএনপি-জামাতের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চারটি ও মঙ্গলবার আরও পাঁচটি সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না।”
ডেমোক্রেসিওয়াচ, খান ফাউন্ডেশন, লাইটহাউজ, মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ, জাগরণ চক্র ফাউন্ডেশন, নবলোক, শরিয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি এবং কোস্টট্রাস্টের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এই সংগঠনগুলো ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য।
হামলা-সহিংসতা
দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় এ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়েছেন ১৪ জন প্রার্থী, যাদের সবাই বিএনপিসহ বিরোধী দলের। আর প্রার্থীদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৩০টি।
গত ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরই সারা দেশে ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়। পত্রিকাটির হিসেবে, ১০ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনে সারা দেশে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ২০৭টি। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ৭৩৪ জন।
নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর সহিংসতায় মারা গেছেন দুজন, একজন নোয়াখালীতে অন্যজন ফরিদপুরে। দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম নির্বাচন কমিশন ও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারি দলের পাঁচ নেতা–কর্মী সহিংসতায় মারা গেছেন।
শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত নির্বাচনের প্রচার চলবে। এরপর ভোট অনুষ্ঠিত হবে ৩০ ডিসেম্বর।